আমি কে? (কল্পনাভিত্তিক একটি লেখা)
মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ
অদৃশ্য জগতের কোনো কিছুকে শুধু কল্পনার ভিত্তিতে আকীদা বানানো যায় না। এমনকি তথ্য হিসেবেও গ্রহণ করা যায় না। সে জন্য দরকার যথাযোগ্য দলীল। তবে অদৃশ্য জগতের কোনোকিছু নিয়ে ভাবতে দোষ নেই; যদি সে ভাবনায় মুনকার কিছু না থাকে। এমনি একটি সুন্দর ভাবনা পেশ করা হয়েছে লেখাটিতে।
আল্লাহ তাআলা কবুল ও মাকবুল করুন। আমীন।-মুহাম্মাদ আবদুল মালেক
আমার কোন নাম ছিলো না, আমার কোন শরীর ছিলো না। আমাকে তখন শুধু রূহ বলা হতো। তখনকার কথা আমার কিছু মনে নেই। শুধু মনে আছে, সমস্ত রূহকে আল্লাহ একত্র করেছিলেন। রূহের সেই জলসায় আমিও হাযির ছিলাম। নূর থেকে আওয়াজ শুনেছিলাম, তোমরা আমাকে চিনেছো? বলো তো আমি কে? আমি কি তোমাদের রব নই? সমস্ত রূহ একসঙ্গে বলেছিলো, আমিও বলেছিলাম, অবশ্যই আপনি আমাদের রব।
রূহদের সেই জলসার পর কত যুগ পার হলো, আমার কিছু মনে নেই, আমার কিছু জানা নেই।
কিছুদিন আগে হঠাৎ আমাকে বলা হলো, চলো, তোমার শরীর তৈরী হয়েছে। এখন তোমাকে রূহের জগত ছেড়ে প্রবেশ করতে হবে শরীরের জগতে। আমি অবাক হলাম, কারণ আমি জানি না, শরীর কী? শরীর কোথায়? শরীরের জগত কেমন? সেখানে গিয়ে আমি কী করবো?
হঠাৎ আমি নড়ে উঠলাম। আমি?! আমি কে? আমি কোত্থেকে এলাম? কোথায় এলাম? এখানে এত অন্ধকার কেন? হঠাৎ দেখি, চারদিকে অনেক নূর! মনে হয় আমার পরিচিত! কোথায় যেন দেখেছি! কোথায় যেন একসঙ্গে থেকেছি! তাতে আমার অজানা ভয়টা দূর হলো, অস্থিরতাটা শেষ হলো। তবু কিসের যেন একটুখানি অস্বস্তি! কী যেন ছিলো! কী যেন নেই! নূরগুলো আমাকে দেখে হাসে, যেন অভয় দিতে চায়। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কে আমি? কে তোমরা? কোথায় যেন তোমাদের দেখেছি!
নূরগুলো খুব কোমল করে বললো, আমরা ফিরেশতা। তুমি ইনসান। যতদিন তুমি এখানে থাকবে, আল্লাহর হুকুমে আমরা তোমার দেখা-শোনা করবো এবং তোমাকে হেফাযত করবো। ‘আল্লাহ’ শব্দটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমি খুশী হয়ে গেলাম। ‘কী যেন ছিলো, কী যেন নেই’ সেই অস্বস্তিটা একেবারে দূর হয়ে গেলো। মনে পড়ে গেলো রূহের জলসা। সেই জলসায় আল্লাহ সমস্ত রূহকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আমি কি তোমাদের রব নই? সমস্ত রূহ বলেছিলো, আমিও বলেছিলাম, অবশ্যই আপনি আমাদের রব।
নূরের ফিরেশতাদের জিজ্ঞাসা করলাম, আমি এখানে কেন? এখানে এত অন্ধকার কেন? রূহের জগতে তো কোন অন্ধকার ছিলো না। শুধু নূর ছিলো, সবকিছু কত আলোকিত ছিলো!
ফিরেশতারা বললো, তুমি রূহের জগতে ছিলে। এখন তুমি তোমার শরীরে প্রবেশ করেছো। আল্লাহর হুকুমে এখানে তোমার শরীর তৈরী করা হয়েছে এবং তোমাকে তোমার শরীরে প্রবেশ করানো হয়েছে।
ফিরেশতাদের কথায় আমি খুব অবাক হলাম। নড়াচড়া করে আমার শরীরকে বোঝার চেষ্টা করলাম। ফিরেশতারা ব্যস্ত হয়ে আমার চারপাশে জড়ো হলো, আর আমাকে বললো, বেশী নড়াচড়া করো না, তাহলে তোমার মায়ের কষ্ট হবে। আমি আরো অবাক হলাম, মা! রূহের জগতে এ শব্দ তো কখনো শুনিনি! বড় মধুর তো শব্দটি! মা! কাকে বলে মা! কেমন তিনি দেখতে! কিছুই বুঝতে না পেরে আমি শুধু অবাক হই, আর ভাবি, মা! মা! কে আমার মা! কোথায় তিনি! কোথায় আমি! আমার মায়ের কাছে কীভাবে যাবো আমি!
ফিরেশতারা হেসে আমাকে বলে, তুমি তো এখন তোমার মায়ের গর্ভে, তোমার মায়ের উদরে। তাই তো এখানে এত অন্ধকার। তুমি এখন এখানে থাকবে। তারপর যখন সময় হবে তখন আল্লাহর হুকুমে তুমি মায়ের গর্ভ থেকে বের হয়ে দুনিয়াতে যাবে। তখন তোমার মাকে তুমি দেখতে পাবে। তোমার মা তোমাকে অনেক আদর করবেন। এখন যেমন অনেক কষ্ট করে তোমাকে গর্ভে ধারণ করছেন, তেমনি তখন অনেক কষ্ট করে তোমাকে লালন পালন করবেন।
গর্ভ, উদর, দুনিয়া- এগুলো আমি বুঝি না, শুধু ‘মা’ শব্দটি আমার খুব ভালো লাগে। আমি ব্যাকুল হয়ে ফিরেশতাদের জিজ্ঞাসা করলাম, আমার জন্য আমার মায়ের খুব কষ্ট হয়? ফিরেশতা বললো, হাঁ, খুব কষ্ট হয়, তবে তোমার মা তোমার জন্য সব কষ্ট হাসিমুখে গ্রহণ করছেন। তিনি যে তোমাকে ভালোবাসেন! তিনি যে তোমাকে তার কোলে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছেন।
আমার তখন নড়াচড়া করতে খুব ইচ্ছে হলো। কিন্তু আমি চুপ করে থাকলাম। মনে পড়লো, ফিরেশতাদের কথা, নড়াচড়া করলে আমার মায়ের কষ্ট হবে। এমনিতেই তো তার কত কষ্ট হচ্ছে। মা! আমার মা! তুমি দেখতে কেমন মা? তোমাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে মা!
কিসের শব্দ হচ্ছে! ধুক ধুক ধুক! একটানা শব্দ, কিসের শব্দ! আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। এ শব্দটা তো রূহের জগতে ছিলো না! আমি অবাক হয়ে ফিরেশতাদের জিজ্ঞাসা করলাম। আমার অবাক হওয়া দেখে ফিরেশতারা হাসলো। হেসে বললো, এই যে দেখো, এটা হলো তোমার হৃদপিন্ড। মানুষ যতক্ষণ বেঁচে থাকে ততক্ষণ তার হৃদপিন্ড ধুক ধুক করে। যখন মৃত্যু হয় তখন ধুক ধুক করা বন্ধ হয়ে যায়। তোমার মায়ের হৃদপিন্ডটা ধুক ধুক করছে, তোমার হৃদপিন্ডেও সেই ধুক ধুক আওয়াযটা হচ্ছে। এই যে দেখো, তোমার নাড়ি তোমার মায়ের সঙ্গে লেগে আছে। তাই তো তুমি তোমার মায়ের প্রাণ থেকে প্রাণ পাচ্ছো! তোমার মায়ের শরীর থেকে এই নাড়ির মাধ্যমে তুমি তোমার খাবার আহরণ করছো। তুমি তো এখন তোমার মায়েরই অংশ।
হৃদপিন্ড, প্রাণ, মৃত্যু, খাদ্য, এগুলো সব নতুন শব্দ। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি ফিরেশতাকে শব্দগুলোর অর্থ জিজ্ঞাসা করলাম। ফিরেশতা হেসে বললেন, রূহ যতক্ষণ শরীরে বাস করে ততক্ষণ মানুষ বেঁচে থাকে। যখন রূহ শরীর থেকে বের হয়ে যায় তখন মৃত্যু হয়। মৃত্যুর সময় রূহ আবার আল্লাহর কাছে ফিরে যায়। আমি অস্থির হয়ে বললাম, আমাকে আমার শরীর থেকে এখনই বের করে নাও। আমার কিছু ভালো লাগছে না। আমি এখনই আল্লাহর কাছে ফিরে যেতে চাই।
ফিরেশতা হেসে বললো, সে তো হবে না। যত দিন আল্লাহর ইচ্ছা তত দিন রূহকে শরীরের জগতে বাস করতে হবে। যখন আল্লাহর হুকুম হবে শুধু তখন রূহ শরীর থেকে বের হবে এবং আল্লাহর কাছে ফিরে যাবে।
আচ্ছা, আমি তো রূহ, আমি যখন শরীর থেকে বের হয়ে আল্লাহর কাছে ফিরে যাবো, তখন শরীরটার কী হবে?
ফিরেশতা হেসে বললো, তোমার সবকিছু জানার খুব ইচ্ছে, না! ভালো; শোনো, শরীরটাকে তখন কবর দেয়া হবে।
কবর! সে আবার কী!
কবর কি তা এখন তুমি বোঝবে না। যখন দুনিয়াতে যাবে তখন বুঝতে পারবে। এখন শুধু এতটুকু বুঝে রাখো, এই যে তোমার মায়ের গর্ভ, কবরও ঠিক এমন কিছু। মায়ের গর্ভ থেকে তুমি দুনিয়াতে যাবে, তারপর দুনিয়া থেকে কবরের ভিতরে যাবে।
ফিরেশতাকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, দুনিয়াটা কী? সেখানে গিয়ে কী হবে?
ফিরেশতা বললেন, মায়ের গর্ভ থেকে বের হয়ে তুমি যেখানে যাবে সেটাই হলো দুনিয়া। সেখানে গিয়ে তুমি ধীরে ধীরে বড়ো হবে। তখন তোমাকে আল্লাহর হুকুম মেনে চলতে হবে। যারা আল্লাহর হুকুম মেনে চলে তারা মৃত্যুর পর কবরে শান্তি পায়। আর যারা আল্লাহর হুকুম অমান্য করে মৃত্যুর পর কবরে তাদের কঠিন শাস্তি হয়। তারপর আল্লাহ সবাইকে কবর থেকে বের করে হাশরের মাঠে জমা করবেন এবং সবার বিচার করবেন। যারা ভালো তাদেরকে জান্নাত দেবেন। সেখানে তারা চিরকাল শান্তিতে থাকবে। আর যারা মন্দ তাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। সেখানে তারা অনন্তকাল কঠিন আযাব ভোগ করবে।
আমি বললাম, আমাকে সব কথা বলে দিয়ে ভালোই করেছো। আমি যখন দুনিয়াতে যাবো তখন আল্লাহর হুকুম মেনে চলবো, কখনো আল্লাহর নাফরমানি করবো না। কারণ আমি জান্নাতে যেতে চাই, জাহান্নামে যেতে চাই না।
***
আমার কোন কষ্ট নেই। ফিরেশতাদের সঙ্গে কথা বলে আমার খুব ভালো লাগে, আমি অনেক কিছু জানতে পারি। আমাকে গর্ভে ধারণ করে আমার মা কত কষ্ট করছেন এখন আমি তা বুঝতে পারি। আমাকে গর্ভে নিয়েই আমার মাকে উঠতে হয়, বসতে হয়, চলতে হয়, সব কাজ করতে হয়। কত কষ্ট! আমার মা কেন এত কষ্ট করছেন!
ফিরেশতারা বলছে, আমি নিজেও বুঝতে পারি, আগের চেয়ে আমি কিছুটা বড় হয়েছি। আমি যত বড় হচ্ছি, আমার মায়ের কষ্ট তত বেশী হচ্ছে। মায়ের কষ্ট হয় ভেবে আমারও কষ্ট হয়। আমার অনেক নড়াচড়া করতে ইচ্ছে করে, কিন্তু করি না। মায়ের যে কষ্ট হয়! কিন্তু সবসময় মনে থাকে না তো! একদিন হাতপাগুলো একটু জোরে নেড়ে ফেলেছি, আর আমার মা ‘উফ’ করে উঠেছেন। আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম। তখন নিজের উপরই আমার খুব রাগ হলো। কেন মাকে কষ্ট দিলাম!
আরো কিছু দিন পর আমি আরেকটু বড় হয়েছি। এখন আমি অনেক কিছু বুঝতে পারি। আগে বুঝতাম না; এখন বুঝতে পারি, কখন আমার মা ঘুমিয়ে আছেন, কখন জেগে আছেন।
একদিন ফিরেশতা বললেন, এই যে, এখন তোমার মা নামায পড়ছেন! তারপর থেকে আমি বুঝতে পারি, কখন আমার মা নামায পড়েন।
এখন তার নামায পড়তে, সিজদা দিতে অনেক কষ্ট হয়। তবু তিনি নামায পড়েন। নামায পড়া যে আল্লাহর হুকুম!
একদিন খুব জোরে শব্দ হলো। আমি ভয় পেয়ে খুব জোরে নড়ে উঠলাম। আমার মা ‘আহ’ করে উঠলেন, তারপর চুপ হয়ে গেলেন। ধুক, ধুক শব্দটাও খুব কমে গেলো। আমার খুব কান্না পেলো। ফিরেশতাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমার মায়ের কী হলো, ফিরেশতা?
ফিরেশতা বললো, তোমার মা এখন অনেক দুর্বল তো! তাই তোমাকে বহন করে হাঁটতে তার অনেক কষ্ট হয়। তবু তাঁকে হাঁটতে হয়, কাজ করতে হয়। এখন হাঁটতে গিয়ে তোমার মা পড়ে গিয়েছেন। পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছেন।
ইস্! আমারই জন্য আমার মায়ের এত কষ্ট! আমাকে বলে দাও না ফিরেশতা! কী করলে আমার মায়ের কষ্ট দূর হবে?
ফিরেশতা বললেন, তুমি আল্লাহর কাছে দু‘আ করো।
সেদিন থেকে আমি আল্লাহর কাছে দু‘আ করি; হে আল্লাহ, রূহের জলসায় তোমাকে রবব বলেছি। এখন তুমি আমার মাকে শক্তি দাও, তার কষ্ট দূর করে দাও।
ফিরেশতারা আমার দু‘আ শোনে, আর বলে, তুমি খুব ভালো ছেলে। আল্লাহ তোমার দু‘আ কবুল করবেন।
ছেলে! এটা তো নতুন শব্দ! ছেলে মানে কি ফিরেশতা!
আমার প্রশ্ন শুনে ফিরেশতাদের কী যে হাসি! ফিরেশতা আমাকে ছেলে আর মেয়ে বুঝিয়ে দিলো। ফিরেশতা বললো, তুমি যেমন তোমার মায়ের গর্ভে এসেছো, তেমনি আরো অনেক রূহ আরো অনেক মায়ের গর্ভে এসেছে। কেউ হয় ছেলে, কেউ হয় মেয়ে।
এখন আমি বুঝতে পেরেছি, রূহের জগতে প্রতিদিন কিছু রূহ কেন কমে যেতো। আসলে তাদের শরীর তৈরী হতো, আর তারা মায়ের গর্ভে চলে আসতো।
একদিন শুনি আমার মা কোরআন তিলাওয়াত করছেন। আমি বুঝতাম না, এখন বুঝি। মা যখন তিলাওয়াত করেন আমার কী যে ভালো লাগে! তখন আমি একদম নড়ি না। চুপচাপ শুনতে থাকি মায়ের তিলাওয়াত।
তিলাওয়াত শেষ করে আমার মা মুনাজাত করছেন, আমি শুনতে পাচ্ছি। মা কাঁদছেন; কান্নাও শুনতে পাচ্ছি। কেঁদে কেদেঁ মা বললেছন, আয় আল্লাহ! আমার সন্তানকে তুমি রক্ষা করো; সুস্থ রাখো। হে আল্লাহ সন্তানকে তুমি নেক বানিও। হাফেয আলেম বানিও।
আমি খুব অবাক হলাম। মা তো আমাকে দেখেননি। আমি তো এখনো দুনিয়াতে যাইনি। তবু আমার জন্য মায়ের কত চিন্তা! মা তো আল্লাহর কাছে নিজের জন্য কিছু বলেননি, শুধু আমার জন্য দু‘আ করেছেন।
ফিরেশতা বললেন, এখন তুমিই তোমার মায়ের সব। তাই মা শুধু তোমার কথা ভাবেন। শুধু তোমার জন্য দু‘আ করেন।
আমার মা খুব ভালো, না ফিরেশতা?!
ফিরেশতা হেসে বললেন, সব মা-ই তার সন্তানের জন্য ভালো। সব মা-ই তার সন্তানের জন্য একই রকম কষ্ট করেন।
আরো কিছু দিন পর ফিরেশতা বললেন, আমার নাকি দুনিয়ায় যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। আর বেশী দেরী নেই। তখন ফিরেশতা বললেন, তোমাকে একটা কথা বলি, মন দিয়ে শোনো।
তুমি যখন দুনিয়াতে যাবে এবং একসময় বড় হবে তখন কিন্তু তোমার মাকে কষ্ট দিও না। যারা মাকে কষ্ট দেয় আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন না। তারা জান্নাতে যেতে পারে না। তারা জাহান্নামে যায়।
আমি অবাক হয়ে বললাম, যাহ! মাকে কষ্ট দেবো কেন? তিনি তো এখনই আমার জন্য কত কষ্ট করছেন!
ফিরেশতা হেসে বললেন, কিন্তু দুনিয়াতে গিয়ে অনেকে এ কথা ভুলে যায়। সন্তানকে গর্ভে ধারণ করে মা কত কষ্ট করেছেন তা ভুলে যায়। ভুলে গিয়ে মাকে কষ্ট দেয়।
আমি বললাম, তুমি দেখে নিও ফিরেশতা, আমি তাদের মত হবো না। আমি আমার মাকে কখনো কষ্ট দেবো না।
***
কত ছোট ছিলাম আমি! কত ছোট ছিলো আমার শরীর! এখন আমি আর সেই ছোট্টটি নই। ধীরে ধীরে অনেক বড় হয়েছি। ফিরেশতা আমাকে বলেছেন। দুনিয়াতে বাতাস আছে। মানুষ নাক দিয়ে বাতাস গ্রহণ করে, আবার নাক দিয়ে বাতাস ত্যাগ করে। এটাকে বলে শ্বাস-নিঃশ্বাস। শ্বাস-নিঃশ্বাসের মাধ্যমেই মানুষ বেঁচে থাকে। আমার মা তো দুনিয়াতে আছেন। সেখানে তিনি শ্বাস গ্রহণ করছেন, আবার নিঃশ্বাস ত্যাগ করছেন। আমার মায়ের শ্বাস-নিঃশ্বাসের মাধ্যমেই আমি বেঁচে আছি। আমি যে, আমার মায়েরই অংশ!
ফিরেশতা একবার আমাকে আববার কথা বললেন। আমি অবাক হয়ে বললাম, আববা! আববা আবার কে? আম্মাকে তো চিনতে পেরেছি। আম্মার বুকের ধুক ধুক শব্দ আমি শুনতে পাই। কিন্তু আববা! কই তাকে তো চিনি না।
ফিরেশতা হেসে বললেন, আম্মাকে যেমন করে চিনেছো, আববাকে এখন তেমন করে চিনতে পারবে না। যখন তুমি দুনিয়াতে যাবে তখন তোমার আম্মা তোমাকে চিনিয়ে দেবেন। তখন তোমার আববাকে তুমি চিনতে পারবে। তোমার আববাও তোমাকে খুব ভালোবাসেন। তিনিও তোমাকে কাছে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছেন।
আমি বললাম, থাকগে, এখন চিনে কাজ নেই। আম্মা যখন চিনিয়ে দেবেন তখনই চিনে নেবো। এখন আমি আম্মা ছাড়া কাউকে চিনি না, চিনতে চাইও না।
***
কী হলো! কী হলো ফিরেশতা! আমার মা এমন কেন করছেন! কী হলো মায়ের! বলো না ফিরেশতা, আমার যে খুব ভয় করছে!
যাই বলি, নূরের ফিরেশতার মুখে শুধু নূরানি হাসি! ফিরেশতা হেসে বললেন, তোমার মায়ের ব্যথা শুরু হয়েছে। এটাকে বলে প্রসববেদনা। সন্তানের জন্মের সময় মায়ের প্রসববেদনা শুরু হয়। তখন খুব কষ্ট হয়। এমন কঠিন কষ্টও মায়েরা হাসিমুখে সহ্য করেন সন্তানকে কোলে পাওয়ার জন্য।
মায়ের কষ্টটা বুঝতে পেরে আমার খুব কান্না পেলো। কিন্তু এখন আমি কাঁদতে পারি না। ফিরেশতা বললেন, দুনিয়াতে গেলেই তোমার কান্না শুরু হবে। তোমার কান্না শুনেই তোমার মায়ের মুখে হাসি ফোটবে। তোমাকে দেখেই তোমার মা সব কষ্ট ভুলে যাবে।
হঠাৎ শুনি মা কাঁদছেন। কেঁদে কেঁদে বলছেন, মা আমার যদি মৃত্যু হয়, আমার বাচ্চাকে তুমি দেখো। আমার বাচ্চাকে তুমি আদর-যত্ন করো।
আমি তো অবাক। আমার মায়ের তাহলে মা আছে! কিন্তু মায়ের মৃত্যু হবে কেন? ফিরেশতা বললেন, সন্তান প্রসব করার সময় অনেক মায়ের মৃত্যু হয়। তবু মা কী চায় জানো, আমার মৃত্যু হোক, তবু আমার সন্তান নিরাপদে
জন্ম লাভ করুক। আমার প্রাণ নিয়ে আমার সন্তান বেঁচে থাক।
আবার আমার কান্না পেলো। মা, আমার মা! তুমি এত ভালো, মা! এত কষ্টের মধ্যেও, মৃত্যু হতে পারে জেনেও তুমি নিজের কথা ভাবছো না মা! ভাবছো শুধু আমার কথা!
তুমি ভেবো না মা! তোমার কিচ্ছু হবে না মা! হে আল্লাহ, আমার মাকে তুমি বাঁচিয়ে রেখো। দুনিয়াতে গিয়ে মাকে যেন দেখতে পাই।
হঠাৎ কী যে হলো! আমার মা ‘আল্লাহ’ বলে চিৎকার করে উঠলেন, আর আমি কেঁদে উঠলাম! এবং আশ্চর্য! মায়ের চিৎকার যেমন শুনলাম, তেমনি নিজের কান্নার আওয়াযও শুনতে পেলাম। আর শুনলাম, কারা যেন বলে উঠলো, ‘আলহামদু লিল্লাহ’!
ফিরেশতাদের মুখে এত দিন শুনেছি; কিন্তু এ তো ফিরেশতাদের কণ্ঠ নয়! এরা তাহলে কারা! এরা এত খুশী কেন? আমার মা! কোথায় আমার মা!
কে যেন বললো, নাও ছেলেকে কোলে নাও; দেখো তোমার ছেলে কত সুন্দর হয়েছে। আল্লাহ তোমাকে কত সুন্দর ছেলে দিয়েছেন! দেখলাম! এই যে আমি দেখলাম আমার মাকে। একটু আগে এই মায়েরই গর্ভে ছিলাম আমি। কত কষ্ট হয়েছে তার! তবু তার মুখে কী সুন্দর হাসি! ফিরেশতাদের হাসি দেখেছি। কত সুন্দর হাসি। আমার মায়ের হাসি যে আরো সুন্দর! ফিরেশতাদের হাসি নূরের হাসি, আমার মায়ের হাসি জান্নাতের হাসি।
মা আমাকে কোলে নিতে পারলেন না, শুধু আমাকে দেখলেন, আর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। ফিরেশতারা আমাকে কত ছুঁয়েছেন! কত আদর করেছেন। কিন্তু মায়ের ছোঁয়া! মায়ের হাতে স্পর্শ!
মাকে দেখে আমি হাসতে চাই, কিন্তু হাসতে পারি না। শুধু কাঁদতে পারি, তাই শুধু কাঁদতে থাকি।
ফিরেশতারা আমাকে শিখিয়েছিলেন, ডান ও বাম, আর বলেছিলেন। তুমি যখন দুনিয়াতে যাবে, তোমার ডান কানে আযান দেয়া হবে, আর বাম কানে ইকামত দেয়া হবে। আযান কাকে বলে, ইকামত কাকে বলে, জানতাম না, ফিরেশতারা বুঝিয়ে দিয়েছেন।
ফিরেশতাদের কথা সত্য হলো। আমার ডান কানে আযান দেয়া হলো এবং বাম কানে ইকামত দেয়া হলো। তখন আমার কান্না থেমে গেলো। আমি চুপ করে আযান, আর ইকামত শুনলাম। আযান কত ভালো, ইকামত কত সুন্দর! শুনতে কত আরাম লাগে!
***
মায়ের গর্ভে যখন ছিলাম, দিন, আর রাত বুঝতে পারিনি। এখন বুঝতে পারি। ফিরেশতারা দিন-রাত বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। আমার মা এত দুর্বল যে, উঠতে পারেন না। মা আমার দিকে কেমন করে তাকিয়ে থাকলেন, তারপর বললেন, আম্মা, আমাকে ধরেন, বাচ্চাকে কোলে নেবো।
একজন কাছে এলেন, যেন ঠিক মায়ের মত! আচ্ছা, ইনি আমার মায়ের আম্মা! মনে পড়লো, মা বলেছিলেন, মা, আমার মৃত্যু হলে আমার বাচ্চাকে তুমি দেখো। আমার বাচ্চাকে তুমি আদর-যত্ন করো।
মাকে খুব যত্ন করে তিনি উঠিয়ে বসালেন, তারপর আমাকে তুলে মায়ের কোলে দিলেন। মা আমাকে কোলে নিলেন, কত আদর করে আমার কপালে চুমু খেলেন, আর বললেন, আলহামদু লিল্লাহ! রূহের জগতের শব্দ, শুনতে কী যে ভালো লাগে!
মা আমাকে কোলে নিলেন, আর আমার কান্না থেমে গেলো! এত আরাম হলো! এত শান্তি হলো!! ফিরেশতাদের কাছে শুনেছি, মায়ের কোল। মায়ের কোলে এত আরাম! এত শান্তি! তখন বুঝিনি। মা, অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন! মনে হলো, আমাকে কোলে নিয়ে তার অনেক শান্তি হলো। আমিও তাকিয়ে আছি অবাক চোখে মায়ের দিকে। ইচ্ছে করে, ডাকি, মা! মা! কিন্তু আমার কানে আওয়ায আসে, ওয়া! ওয়া!
মা আমাকে আদর করেন, আর বলেন, কাঁদে না বাবা, কাঁদে না! আমি অবাক হয়ে বলতে চাই, কাঁদছি না তো মা! তোমাকে ডাকছি মা! কিন্তু আমি শুধু কাঁদতে পারি, কিছু বলতে পারি না।
***
একজন মানুষ এসে মায়ের সামনে দাঁড়ালো। আমি তখন মায়ের কোলে। মা বললেন, বাবা তো হয়েছো, ছেলেকে কোলে নেবে না! বাবা! আববা!! ফিরেশতা যে বলেছিলেন, মা আমাকে চিনিয়ে দেবেন আববা! ইনি তাহলে আমার আববা!! মনে হলো আববা আমাকে কোলে নিতে চান, কিন্তু ভয় পান। মা তো এমন করেননি! আমাকে কোলে নিতে বাবার এত ভয় কেন?!
মা খুব সাবধানে আমাকে বাবার কোলে দিলেন, আর বললেন, দেখো, সাবধানে ধরো! মারও দেখি ভয় আমাকে বাবার কোলে দিতে! আমার খুব হাসি পেলো। কিন্তু হাসিটা হয়ে গেলো কান্না! ওয়া! ওয়া!
বাবা কেমন যেন ভয় পেলেন, এই বুঝি আমি পড়ে যাবো তার কোল থেকে। তাড়াতাড়ি বাবা আমাকে মায়ের কোলে দিয়ে দিলেন, মাও তাড়াতাড়ি কোলে নিয়ে নিলেন, আর বললেন, একটু বড় হোক তখন কোলে নিয়ো।
বাবার মুখটা কেমন মলিন হয়ে গেলো। আমি বলতে চাইলাম, বাবা, আমি কাঁদিনি, আমি হেসেছি! কিন্তু আমার হাসিটা যে কান্না হয়ে যায়!
তারপর থেকে বাবাকে দেখি প্রতিদিন একবার, বা দু’বার। আর মাকে দেখি,
যখনি চোখ খুলি। চোখ খুলে যখন মাকে দেখি না, ইচ্ছে হয় মা! মা! বলে ডাকি,
কিন্তু পারি না, শুধু বলি, ওয়া! ওয়া!
আমার কান্না শুনে মা ছুটে আসেন, আমাকে কোলে তুলে নেন। কী আরাম! কী শান্তি!!
ফিরেশতা বলেছিলেন ক্ষুধার কথা, দুধের কথা! মায়ের বুকের কথা!! এটাকেই বোধহয় ক্ষুধা বলে, আমি কেঁদে উঠলাম। আর মা আমাকে কোলে তুলে নিলেন, আমার দিকে তাকিয়ে কী
সুন্দর করে হাসলেন, আর বললেন, আমার বাবার ক্ষুধা পেয়েছে? তখন বাবা ছিলেন, মা বললেন, যাও তো এখন, আমার বাবা দুধ খাবে। বাবা একটু হেসে চলে গেলেন। আমি তো অবাক, বাবাকে যেতে হবে কেন?!
সেদিন প্রথম দুধ খেলাম। মায়ের বুকের দুধ। কী স্বাদ! কী শান্তি! কোত্থেকে আসে এই দুধ! জান্নাত থেকে!! ফিরেশতা তো বলেছিলেন, জান্নাতে আছে দুধের নহর!
***
মায়ের গর্ভে যখন ছিলাম ফিরেশতারা ছিলেন আমার সঙ্গী। ফিরেশতাদের খুব ভালো লাগতো। দুনিয়াতে এসে ফিরেশতাদের দেখিনি। আজ প্রথম দেখলাম। দেখে আমার খুব ভালো লাগলো। আমি দোলনায় ছিলাম। ঘুমিয়ে ছিলাম। চোখ মেলে দেখি, ফিরেশতা! ফিরেশতাকে দেখে হেসে উঠলাম। এবার হাসিটা আর কান্না হলো না। খুব সুন্দর হাসি হলো। সেই হাসি দেখে আমার মায়ের কী যে আনন্দ হলো! তিনি আমাকে কোলে নিলেন, বুকে নিলেন, কপালে চুমু খেলেন, আর বললেন, আমার বাবা ফিরেশতা দেখেছে, ফিরেশতাদের সঙ্গে হাসছে! আমি তো অবাক! মা কি ফিরেশতাকে দেখতে পেয়েছেন? বড়রা কি ফিরেশতা দেখতে পায়?
একদিন বাবা বললেন, দেখো, আমার ছেলে আগে আববা বলবে। মা হেসে বললেন, কেন! এত কষ্ট কে করলো শুনি! আমার ছেলে আগে আম্মা বলবে।
আমি সব শুনি, সব বুঝি কিন্তু কিছু বলতে পারি না। শুধু কাঁদতে পারি। এখন অবশ্য হাসতেও পরি। হাসিটা এখন আর কান্নার মত হয় না, হাসির মতই হয়।
একদিন দোলনায় ঘুমিয়ে আছি। তখন দেখি সেই ফিরেশতা। আমি বলাম, ফিরেশতা, তুমি এখন আর আসো না কেন? এদিকে আমার যে বড় বিপদ!
ফিরেশতা হেসে বললেন, কী বিপদ শুনি! বললাম, আগে আববা বলবো, না আম্মা বলবো! যদি আম্মা বলি, আববার যদি কষ্ট হয়। যদি আববা বলি, আম্মার কষ্ট হবে না!
ফিরেশতা হেসে বললেন, তোমার ইচ্ছে! আমার তো ইচ্ছে আম্মা বলি, মা আমার জন্য কত কষ্ট করেছেন!
ফিরেশতা বললেন, তুমি কি ভুলে গিয়েছো, আল্লাহর কথা! রূহের জলসার কথা! তোমার মাকে তোমার বাবাকে সন্তান কে দিয়েছেন? আল্লাহ! তোমাকে মা এবং বাবা কে দিয়েছেন? আল্লাহ!
আমি হেসে বললাম, বুঝতে পেরেছি ফিরেশতা! আমি সবার আগে বলবো, আল্লাহ!
আশ্চর্য! বললাম, আর নিজের কানেও শুনতে পেলাম, আল্লাহ! মা ছিলেন, বাবা ছিলেন, দু’জনই অবাক হয়ে বলে উঠলেন, আল্লাহ!
শুনেছো, আমাদের ছেলে আল্লাহ বলেছে!
মা খুশী হলেন, বাবা খুশী হলেন। মা আমাকে কোলে তুলে নিলেন, আর বাবা বললেন, সবাইকে আজ মিষ্টি খাওয়াতে হবে।
আচ্ছা, আমি যখন বড় হবো, এই সব কথা কি তখন ভুলে যাবো? রূহের জগত, রূহের জলসা, নূরের ফিরেশতা, মায়ের গর্ভ, মায়ের কোল! এই প্রথম আল্লাহ বলা?!