বৃহস্পতিবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

টেরোরিস্ট আমরিকান ডলার কেন বিশ্ব শাসন করছে?

সৌদি রাজা, পৃথিবীর বোঝা !
টেরোরিস্ট আমরিকান ডলার কেন বিশ্ব শাষন করছে? এই পোস্টে সহজে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এর চেয়ে সহজে আমি বুঝাতে পারতাম না।
পেট্রো ডলার কি? তেলের বিপরীতে ডলারই হচ্ছে পেট্রো ডলার। অর্থাৎ আপনি যদি পেট্রোলিয়াম জাতীয় তেল কিনতে চান আপনাকে তা ডলার দিয়েই কিনতে হবে। তো এতে সমস্যা কি? সমস্যা হল আপনাকে তাদের মুখাপেক্ষী হতে হবে যারা কিনা ডলার বানায়। আর তারা হচ্ছে আমরিকা। ধরুন আপনি সৌদিতে গিয়ে বললেন যে আমি তেল কিনবো আপনাদের কাছ থেকে। তারা বলবে ইউএস ডলার দাও, তেল নাও। আপনি বললেন, নাহ! আমার কাছে ইউএস ডলার নেই। আর ইউএস ডলার আনতে গেলে আমরিকা তাদের বিভিন্ন অনাচার চাপিয়ে দিবে, তাই অন্য কোন সম্পদের বিনিময়ে তেল চাচ্ছি। তারা বলবে, নাহ হবে না। আমরা পেট্রো ডলার চুক্তি করেছি, আর আমরা চুক্তি ভাঙতে পারবো না।
.
.
১৯৭১ সালে আমরিকান তৎকালীন প্রেসিডেন্ট নিক্সন ঘোষণা দেয় যে গোল্ড নয়, ইউএস ডলারই হবে মূল রিসার্ভ, স্ট্যান্ডার্ড মানি! যা নিক্সন শক নামে পরিচিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের ভয়ে মিত্রশক্তি তাদের রিসার্ভ গোল্ডগুলো আমরিকায় পাঠানো শুরু করে। অথচ পরে আমরিকা প্রতারণা করে বলে যে গোল্ড আমাদের কাছেই থাকুক, আর তোমরা ডলার নাও। বিশ্বের ২৫% গোল্ড আমরিকা দখল করে বসে আছে। আর বলছে ডলারকে তোমরা রিসার্ভ হিসেবে ইউস করো, এবং ডলারের এগেইন্সেটে তোমাদের কারেন্সী ছাপাও। দেখবেন এদেশের ক্ষেত্রে বলা হয়, আমাদের রিসার্ভ এতএত ইউএস ডলার। কেন ইউএস ডলার? কেন গোল্ড নয়? কেন ইউএস ডলারে সব হিসেব হচ্ছে? যদি ইউএসের পতন হয়, এই রিসার্ভ ডলারের কোন মূল্য নেই। কারণ এগুলো ফিয়াট মানি। এগুলো শূন্যের বিপরীতে বানানো, আইমিন জাস্ট ছাপানো হয়েছে। আর এখন এর মূল্য ইউএসের ইচ্ছার উপর নির্ভশীল। এভাবে ইউএস আমাদের তাদের মুখাপেক্ষী বানিয়ে শোষণ করছে, আর তাদের দাসস্ব বরণ করতে বাধ্য করছে।
.
.
কিন্তু জাস্ট ঘোষণা করেই কি তা হয়ে গেছে? কারণ ডলার যদি কোন কিছুর এগেইন্সেটে না বানানো হয়, তবে ইউএস যতখুশি তত ডলার ছাপাবে, যাকে তাকে যখন খুশি কিনবে, কিন্তু একটা সময় এতএত ডলার থাকায় মুদ্রাস্ফীতি হয়ে ডলার মান আর থাকবে না। কিন্তু এর জন্য ইউসের দরকার এমন কিছু যা গোল্ডের চেয়েও মূল্যবান, এবং যার অনেক চাহিদা আছে, আর যার এগেইন্সটে তারা ডলারের ব্যবসা করবে। গোল্ড তাদের পরিবর্তন করতেই হত। কারণ তারা এত এত ব্যবসায়িক ডিল করেছিল যে, সেগুলোর শোধ করার মত ডলার, আরো ভালো করে বললে গোল্ড তাদের কাছে ছিল না। অথচ ঠিকই তারা ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন, জিলিয়ন জিলিয়ন ডলারের ডিল করছে, খরচ করছে। আদৌ কি তাদের থেকে গোল্ড অথবা অন্য কোন সম্পদ কমছে? কেবল ছাপানো ডলার কমছে! তারা সেটাই তো চায় যে তাদের ডলারই হোক একমাত্র ওয়ার্ল্ড কারেন্সী, কোন বাধা ছাড়াই।
.
.
তো ১৯৭৪ সাথে তারা গেল সৌদি আরবে। বিশ্বে প্রতিদিন এ্যাটলিস্ট ১০% তেল সৌদি বিক্রি করে। তাদের গিয়ে বললো, দেখো, তোমাদের সবরকম সামরিক এবং রাজনৈতিক সমর্থন, অস্ত্র এবং টেকনোলজিকাল সাপ্লাই আমরা দিবো। এর বিপরীতে তোমরা তেল শুধুমাত্র ডলারে বিক্রি করবে। মাথামোটা সৌদিরা রাজী হয়ে গেল। কারণ তারা এমন শক্তিশালী সেনাবাহিনী বানাতে ভয় পায়, যারা কিনা তাদের সিংহাসনের জন্য হুমকি সরূপ। স্বাভাবিকভাবেই একজন যোগ্য সেনাপ্রধান যখন দেখবে যে পেট আর মাথা মোটারা সিংহাসনে বসে আছে, সে লাথি মেরে আগে তাদের সরাবে। তো সৌদি-গল্ফ এজন্য শক্তিশালী সেনাবাহিনী বানাবে না। তাদের দরকার তাদেরই মত পেট আর মাথা মোটা সেনাবাহিনী। আর এজন্য তারা আমরিকার উপর নির্ভশীল। এজন্য নিজ দেশে তারা আমরিকান বেইস বানাতে দিয়েছে। তারা চায় কেবল খেয়ে-দেয়ে ফূর্তি করে রাজতন্ত্র, আর তাদের ব্যবসাপাতি ধরে রাখা।
.
.
তো সৌদিরা তেল ডলারে বিক্রি করা শুরু করলো। তো ডলারগুলো নিয়ে তারা আবার আমরিকাকেই দিল, বিপরীতে আমরিকা তাদের বন্ড ধরিয়ে দিল যে, যখন দরকার পরে বন্ড ভাঙিয়ে খরচ করো। কারণ যত ডলার আমরিকা ছাপাচ্ছে, তত ডলারের সম্পদ কিন্তু আমরিকার কাছে নেই। তাই অতিরিক্ত ডলার না ছাপানোর জন্য, যখনই কোন দেশ ডলার জমায়, তখনই তাদের বন্ড ধরিয়ে দিয়ে সেই ডলার আবার অন্য কাজে লাগায়। আবার নিজেদের কাছেও অনেক ডলার রাখে না, নতুবা আমরিকার মধ্যে ডলারের মান কমবে। তাই তারা চায় ডলার ছড়িয়ে থাকুক। কোথাও জমে গেলে সেটার বিপরীতে বন্ড দিয়ে সেই ডলারগুলো নিয়ে আরেক জায়গায় ব্যাবহার করে, যেন ডলারের ব্যবসা জারী রাখা যায়, এবং মানুষকে মুখাপেক্ষী থাকতে বাধ্য করা যায়। বন্ড বলতে ধরুন ব্যাংকের প্রাইজ বন্ড। আপনারা তা কিনতে পারবেন, আবার ব্যাংকের কাছে একই মূল্যে ভাঙাতে পারবেন। তেমনি অনেক ইউএস ডলার আপনি নিজের কাছে জমিয়ে কি করবেন? আমরিকা বলে আমাদের কাছেই রিসার্ভ রাখুন, ইনভেস্টমেন্ট হিসেবে রাখুন, পরে ইন্টারেস্ট সহ পাবেন। আর কত রেখেছেন সেটার দলীল হিসেবে বন্ড রাখুন। এই বন্ডকে তারা বলে ট্রেসারী বন্ড। এভাবে বারবার আর অপ্রয়োজনে ডলার না ছাপিয়েই আমরিকা কাজ চালাচ্ছে। আর মুদ্রাস্ফীতিও এড়িয়ে চলছে।
.
.
তাহলে তেলের দাম আসলে কারা ভোগ করছে? আমরিকা না সৌদি? ভেবে দেখুন, তেল আসলে বিক্রি করছে আমরিকা। সৌদি সরাসরি আমরিকার একটি প্রদেশ হিসেবে কাজ করছে। শুধু সৌদিই না, কাতার, কুয়েত, আমিরাত এবং আরো যারা আছে, সকলে ইউএসের অংশ হিসেবে কাজ করছে, এবং তাদের অর্থনীতি মূলত ইউএসের অর্থনীতির অংশ। এবং এসব দেশের রাজারা এর বিপরীতে রাজনৈতিক এবং সামরিক সাপোর্ট পাচ্ছে। আমরিকাকে নিজেদের দেশে সেনাঘাটি দিয়েছে। সাদ্দাম, গাদ্দাফি সরার চেষ্টা করেছিল, তারা নিজেরাই সরে গেছে। সম্ভবত বাদশাহ ফয়সালের ক্ষেত্রেও একই কারণ ছিল। আর আমরিকা তাদের ঘাড়ে চড়ে অর্থনীতিতে মনোপলি সৃষ্টি করে নিজেদের মনগড়া বিধান মানুষের উপর চাপাচ্ছে। ফেরাউনের মত নিজেকে আল্লাহর সাথে শরীক করছে, আল্লাহর বিধান রিপ্লেস করার মত স্পর্ধা দেখাচ্ছে। আর এতসব কিছু পেট্রো ডলারের বদৌলতে। সৌদি হল এই চুক্তির মধ্যমণী।
.
.
সৌদির সাথে এই চুক্তি টিকে থাকলে, আমরিকার যে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন খরচ, সেগুলোর ভার আমাদের বহন করতে হবে। কারণ গোল্ড আমরিকার দখলে, তেল আমরিকার দখলে। তারা কেবল ডলার আর বন্ডের লুপিং চালিয়ে যুদ্ধ চালাচ্ছে, নিজেদের বাজার চালু রাখছে অথচ তাদের এত সম্পদ নেই যত তা অলরেডি খরচ করে ফেলেছে, আর কত ডলারের ডিল বাকি আছে সেগুলো হিসাব করলে বলতে হবে যে সেগুলা কারা শোধ করবে? এই আমার আপনার শোধ করতে হবে! কিভাবে? এই যে আমাদের টাকা, যা ডলারের বিপরীতে ছাপা হচ্ছে, সেই ডলারের মান কমলে আমাদের কষ্টে উপার্জিত টাকার মানও কমে যাবে, এই যতটুকু মান কমলো সেটা আমরিকার খরচের হিসাব ঠিক রাখতে কাটা গেছে। আর যতদিন পেট্রো ডলার চুক্তি থাকবে, তেলের বিনিময়ে ডলার তার প্রভুত্ব এভাবেই চালিয়ে যাবে।

বুধবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমানদের অবদান।


আপনি আজ যদি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস দেখেন সেখানে দেখে মনে হবে শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বিরাই স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছে। আপনি দেখবেন যারা জেল খেটেছেন তাঁদের মধ্যে নাম আছে গান্ধীর, নেহেরুর, মতিলালের, সুভাষ বোসের, কৃষ্ণ মেনন, সরোজিনী নাইড়ু, অরবিন্দ, চিত্তরঞ্জন তাঁদের নাম। যারা প্রান দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে ক্ষুদিরাম, বাঘাযতীন, প্রফুল্ল  চাকী, বিনয়, বাদল, দীনেশ, ভগত সিং, প্রীতিলতা, সুর্যসেন। সন্ত্রাসবাদী দলের মধ্যে নাম আছে অনুশীলন আর যুগান্তরের। ইতিহাসে যাদের নাম উল্লেখ আছে অবশ্যই তারা আমাদের সন্মানীয়, কিন্তু এই তালিকায় কোথাও কোন মুসলমানের নাম নেই কেন? মুসলমানেরা ছিলনা সেই লড়াইয়ে? খুব ছিল। তবে তাঁদের নাম নেই কেন? কারণ সেগুলো সযতনে মুছে ফেলা হয়েছে।

১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ এই একশো নব্বুই বছরে হাজার হাজার মুসলমান স্বাধীনতা সংগ্রামী জীবন দিয়েছেন, জেল খেটেছেন। কোলকাতা সিটি কলেজের ইংরেজী বিভাগের প্রধান ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং প্রফেসর  শ্রী শান্তিময় রায়কে এক প্রবীন কংগ্রেসি বলেছিলেন, “স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমানদের ভুমিকা ছিল বৈরি”। এই ঘটনা শান্তিময় রায়কে বিচলিত করে তিনি “ভারতের মুক্তি সংগ্রাম ও মুসলিম অবদান” নামে এক গবেষণা মুলক গ্রন্থ রচনা করেন। সেখানে উঠে আসে সব বীরত্বের কথা যা চেপে রাখা হয়েছিল এবং এখনো হচ্ছে।

আপনাদের সাথে শুধু কয়েকটা শেয়ার করছি।

হাকিম আজমল খাঁ ছিলেন সর্ব ভারতের কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট। সেই সময়ের বিখ্যাত চিকিৎসক। দিল্লীর বাইরে গেলে ফি নিতেন সেইসময়ে এক হাজার টাকা। গরীবদের কাছে থেকে কোন পয়সা নিতেন না। কংগ্রেস নেতা হিসেবে জেল খেটেছেন বহু বছর, নেহেরুর চাইতে তো কম না। সর্বভারতীয় কংগ্রেস সভাপতি হওয়া স্বত্তেও উনার নামটাও ভারতের ইতিহাসে নেই। এমনকি মওলানা আজাদ যে জেল খেটেছিলেন সেই ইতিহাস ও নেই।

খাজা আব্দুল মজিদ, ইংল্যান্ড থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করেন। নেহেরুর সমসাময়িক কংগ্রেস নেতা। তিনি ও তাঁর স্ত্রী দুজনেই জেল খেটেছেন বহু বছর। কোথাও এটার উল্লেখ নেই।

নেতাজী সুভাষ বসুর ডানহাত ও বামহাতের মতো ছিলেন, আবিদ হাসান এবং শাহেনেওয়াজ খান। এদের নাম আছে কোথাও? তাঁর রাজনৈতিক সংগ্রামে আর আজাদ হিন্দ ফৌজে ছিলেন, আজিজ আহমেদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল যেড কিয়ানি, ডি এম খান, আব্দুল করিম গনি, কর্নেল জিলানী। ইতিহাসে কারো নাম নেই।

অমৃতসরের জালিয়ানয়ালাবাগের যে ম্যাসাকারের কথা আমরা জানি, সেটা কার গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে হয়েছিল? সেটা হয়েছিল কংগ্রেস নেতা সাইফুদ্দিন কিচলুর গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে। তিনি ছিলেন অতি জনপ্রিয় নেতা। জনতা তাঁর গ্রেপ্তারের সংবাদে ফুসে উঠেছিল। জার্মানি থেকে ওকালতি পাশ করে আসা সাইফুদ্দিন কিচলুকে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরে পাঠানো হয়। জালিয়ানোয়ালাবাগের নাম জানি, সেখানে ম্যাসাকার হয়েছিল সেটা জানি, জেনারেল ডায়েরের কথা জানি যিনি গুলি চালানোর আদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু যিনি এই প্রতিবাদের প্রাণপুরুষ ছিলেন সেই ব্যারিস্টার সাইফুদ্দিন কিচলু একদম হাওয়া। অদ্ভুত নয়?

আমরা গোপন সন্ত্রাসবাদী দল অনুশীলন যুগান্তরের কথা জানি, যেখানে মুসলমানদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল, কিন্তু ইনকেলাবি পারটির কথা জানিনা। তাঁদের নেতা ছিলেন পালোয়ান শিশু খান। পালোয়ান শিশু খান ইংরেজ বাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে শাহাদাত বরন করেন। শিশু খান ইতিহাসে কোথাও নেই।

ক্ষুদিরাম কিংস্ফোর্ডকে হত্যা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন। কিংস্ফোর্ডের বদলে ভুলে দুজন ইংরেজ নারী নিহত হয়। ক্ষুদিরাম আমাদের কাছে বীর। কিন্তু মহম্মদ আব্দুল্লাহ কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি নরম্যান যিনি অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামীকে নিষ্ঠুরভাবে প্রহসনমুলক বিচারে ফাসির আদেশ দিয়েছিলেন তাঁকে একাই কোর্টের সিড়িতে অসমসাহসে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করেন ১৭৭১ সালের ২০ শে সেপ্টেম্বর। মহম্মদ আব্দুল্লাহ ইতিহাসে স্থান পান নাই।

বীর বিপ্লবী শের আলীর কথা না বললে আজকের লেখা অসম্পুর্ণ থেকে যাবে। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের জন্য তাঁর ১৪ বছর জেল হয়। শের আলী আন্দামানে জেল খাটছিলেন। এমন সময় কুখ্যাত লর্ড মেয়ো আন্দামান সেলুলার জেল পরিদর্শনে আসে। শের আলী সুযোগ বুঝে বাঘের মতোই রক্ষীদের পরাস্ত করে তাঁর উপরে চাকু হাতে ঝাপিয়ে পড়েন। লর্ড মেয়ো আন্দামান জেলেই শের আলীর চাকুর আঘাতে মৃত্যু বরণ করে।

শের আলীর দ্বিতীয়বার বিচার আরম্ভ হয়। বিচারে ফাসির রায় হয়। শের আলী বীরের শহীদি মৃত্যুবরণ করেন ফাঁসি্র কাষ্ঠে। অথচ কি আশ্চর্য, শের আলীর স্থান ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে হয়নি।

Written by Pinaki Bhattacharya..........

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমানদের অবদান।


আপনি আজ যদি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস দেখেন সেখানে দেখে মনে হবে শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বিরাই স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছে। আপনি দেখবেন যারা জেল খেটেছেন তাঁদের মধ্যে নাম আছে গান্ধীর, নেহেরুর, মতিলালের, সুভাষ বোসের, কৃষ্ণ মেনন, সরোজিনী নাইড়ু, অরবিন্দ, চিত্তরঞ্জন তাঁদের নাম। যারা প্রান দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে ক্ষুদিরাম, বাঘাযতীন, প্রফুল্ল  চাকী, বিনয়, বাদল, দীনেশ, ভগত সিং, প্রীতিলতা, সুর্যসেন। সন্ত্রাসবাদী দলের মধ্যে নাম আছে অনুশীলন আর যুগান্তরের। ইতিহাসে যাদের নাম উল্লেখ আছে অবশ্যই তারা আমাদের সন্মানীয়, কিন্তু এই তালিকায় কোথাও কোন মুসলমানের নাম নেই কেন? মুসলমানেরা ছিলনা সেই লড়াইয়ে? খুব ছিল। তবে তাঁদের নাম নেই কেন? কারণ সেগুলো সযতনে মুছে ফেলা হয়েছে।

১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ এই একশো নব্বুই বছরে হাজার হাজার মুসলমান স্বাধীনতা সংগ্রামী জীবন দিয়েছেন, জেল খেটেছেন। কোলকাতা সিটি কলেজের ইংরেজী বিভাগের প্রধান ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং প্রফেসর  শ্রী শান্তিময় রায়কে এক প্রবীন কংগ্রেসি বলেছিলেন, “স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমানদের ভুমিকা ছিল বৈরি”। এই ঘটনা শান্তিময় রায়কে বিচলিত করে তিনি “ভারতের মুক্তি সংগ্রাম ও মুসলিম অবদান” নামে এক গবেষণা মুলক গ্রন্থ রচনা করেন। সেখানে উঠে আসে সব বীরত্বের কথা যা চেপে রাখা হয়েছিল এবং এখনো হচ্ছে।

আপনাদের সাথে শুধু কয়েকটা শেয়ার করছি।

হাকিম আজমল খাঁ ছিলেন সর্ব ভারতের কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট। সেই সময়ের বিখ্যাত চিকিৎসক। দিল্লীর বাইরে গেলে ফি নিতেন সেইসময়ে এক হাজার টাকা। গরীবদের কাছে থেকে কোন পয়সা নিতেন না। কংগ্রেস নেতা হিসেবে জেল খেটেছেন বহু বছর, নেহেরুর চাইতে তো কম না। সর্বভারতীয় কংগ্রেস সভাপতি হওয়া স্বত্তেও উনার নামটাও ভারতের ইতিহাসে নেই। এমনকি মওলানা আজাদ যে জেল খেটেছিলেন সেই ইতিহাস ও নেই।

খাজা আব্দুল মজিদ, ইংল্যান্ড থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করেন। নেহেরুর সমসাময়িক কংগ্রেস নেতা। তিনি ও তাঁর স্ত্রী দুজনেই জেল খেটেছেন বহু বছর। কোথাও এটার উল্লেখ নেই।

নেতাজী সুভাষ বসুর ডানহাত ও বামহাতের মতো ছিলেন, আবিদ হাসান এবং শাহেনেওয়াজ খান। এদের নাম আছে কোথাও? তাঁর রাজনৈতিক সংগ্রামে আর আজাদ হিন্দ ফৌজে ছিলেন, আজিজ আহমেদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল যেড কিয়ানি, ডি এম খান, আব্দুল করিম গনি, কর্নেল জিলানী। ইতিহাসে কারো নাম নেই।

অমৃতসরের জালিয়ানয়ালাবাগের যে ম্যাসাকারের কথা আমরা জানি, সেটা কার গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে হয়েছিল? সেটা হয়েছিল কংগ্রেস নেতা সাইফুদ্দিন কিচলুর গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে। তিনি ছিলেন অতি জনপ্রিয় নেতা। জনতা তাঁর গ্রেপ্তারের সংবাদে ফুসে উঠেছিল। জার্মানি থেকে ওকালতি পাশ করে আসা সাইফুদ্দিন কিচলুকে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরে পাঠানো হয়। জালিয়ানোয়ালাবাগের নাম জানি, সেখানে ম্যাসাকার হয়েছিল সেটা জানি, জেনারেল ডায়েরের কথা জানি যিনি গুলি চালানোর আদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু যিনি এই প্রতিবাদের প্রাণপুরুষ ছিলেন সেই ব্যারিস্টার সাইফুদ্দিন কিচলু একদম হাওয়া। অদ্ভুত নয়?

আমরা গোপন সন্ত্রাসবাদী দল অনুশীলন যুগান্তরের কথা জানি, যেখানে মুসলমানদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল, কিন্তু ইনকেলাবি পারটির কথা জানিনা। তাঁদের নেতা ছিলেন পালোয়ান শিশু খান। পালোয়ান শিশু খান ইংরেজ বাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে শাহাদাত বরন করেন। শিশু খান ইতিহাসে কোথাও নেই।

ক্ষুদিরাম কিংস্ফোর্ডকে হত্যা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন। কিংস্ফোর্ডের বদলে ভুলে দুজন ইংরেজ নারী নিহত হয়। ক্ষুদিরাম আমাদের কাছে বীর। কিন্তু মহম্মদ আব্দুল্লাহ কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি নরম্যান যিনি অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামীকে নিষ্ঠুরভাবে প্রহসনমুলক বিচারে ফাসির আদেশ দিয়েছিলেন তাঁকে একাই কোর্টের সিড়িতে অসমসাহসে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করেন ১৭৭১ সালের ২০ শে সেপ্টেম্বর। মহম্মদ আব্দুল্লাহ ইতিহাসে স্থান পান নাই।

বীর বিপ্লবী শের আলীর কথা না বললে আজকের লেখা অসম্পুর্ণ থেকে যাবে। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের জন্য তাঁর ১৪ বছর জেল হয়। শের আলী আন্দামানে জেল খাটছিলেন। এমন সময় কুখ্যাত লর্ড মেয়ো আন্দামান সেলুলার জেল পরিদর্শনে আসে। শের আলী সুযোগ বুঝে বাঘের মতোই রক্ষীদের পরাস্ত করে তাঁর উপরে চাকু হাতে ঝাপিয়ে পড়েন। লর্ড মেয়ো আন্দামান জেলেই শের আলীর চাকুর আঘাতে মৃত্যু বরণ করে।

শের আলীর দ্বিতীয়বার বিচার আরম্ভ হয়। বিচারে ফাসির রায় হয়। শের আলী বীরের শহীদি মৃত্যুবরণ করেন ফাঁসি্র কাষ্ঠে। অথচ কি আশ্চর্য, শের আলীর স্থান ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে হয়নি।

Written by Pinaki Bhattacharya..........

রবিবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

শিশুদের বিপ্লব থেকে কী শিখলাম?


ছোট ছোট ছেলেমেয়ে সপ্তাহখানেকের আন্দোলনেই আমাদের হৃদয়ে আশার পুনর্জাগরণ ঘটিয়ে দিয়ে গেছে। তারা আমাদের মনে এই বিশ্বাস আবার জাগিয়ে তুলেছে, হয়তো বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিরাপদ হাতেই রয়েছে।
এখন এমন একটি সময় চলছে, যখন দেশের শাসনব্যবস্থার দুর্দশা দেখে বড়রা নির্বিকার ও নেতিবাচক অবস্থায় চলে গেছে। এ রকম একটি সময়ে এই শিশু-কিশোরেরা অন্যায়ের শিকার হয়ে আপন সমস্যা সমাধানে বড়দের মুখের দিকে চেয়ে থাকার প্রথাগত ধারণাকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা অসম সাহস নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েছে। দীর্ঘদিনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার বিষয় যে সড়ক নিরাপত্তা, সেটি নিয়ে তারা যে শুধু স্লোগান দিয়েছে তা-ই নয়, এ সমস্যা সমাধানে কী কী করতে হবে, তা তারা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। রুগ্ণ শাসনব্যবস্থায় সংস্কার আনার ক্ষেত্রে শিশুদের এই আন্দোলনকে আমাদের অনুপ্রেরণা হিসেবে গ্রহণ করার কথা ছিল। কিন্তু তার বদলে রক্তক্ষয় ও অশ্রুপাতের মধ্য দিয়ে যেভাবে এর সমাপ্তি ঘটল, তা আমাদের সবার জন্য এক নিদারুণ অস্বস্তির বিষয় হয়ে থাকল।
গোড়াতে আমরা সবাই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বিষয়ে সরকারের, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর নম্র ও সহানুভূতিশীল প্রতিক্রিয়া লক্ষ করেছি। তখন আমাদের সবার মনে বিশ্বাস হচ্ছিল, এই শিশুরা আসলেই অনুসরণীয় এক মহা বার্তা বয়ে এনেছে। তাদের এই বার্তা অনুসরণ করে আমরা গোটা শাসনব্যবস্থার অন্যান্য ত্রুটি-বিচ্যুতি আমলে নিয়ে সামনে এগোতে পারব।
শিশুদের এই মহতী উদ্যোগের সঙ্গে বিশদ পরিসরে বয়স্ক ব্যক্তিরা অর্থপূর্ণ একাত্মতা প্রকাশ করতে পারতেন। সরকারের গণ্যমান্য ব্যক্তিরাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজের জ্যেষ্ঠ নেতারা রাস্তায় নেমে প্রতীকীভাবে তাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করতে পারতেন। বছরের পর বছর উপেক্ষা করে আসা সড়ক নিরাপত্তা আইন সংস্কার ও তা কার্যকর করতে তাঁরা কী কী উদ্যোগ নিচ্ছেন, তা তাঁরা তুলে ধরতে পারতেন। তাতে শিশু-কিশোরেরা আশ্বস্ত হতে পারত। তাদের মনে এই বোধ জন্ম নিত যে তাদের আন্দোলন একেবারে নিষ্ফলা হয়নি; তখন তারা শান্তিমতো ক্লাসে ফিরতে পারত। তাদের মধ্যে এই বিশ্বাস জন্ম নিত যে তাদের দাবি বাস্তবায়নে বড়দের সমাজের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের ওপর ভরসা করা যায়। কিন্তু শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের উপস্থিতিতে অশুভ অপচ্ছায়ার মতো অস্ত্রধারীরা যেভাবে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করেছে এবং সহিংসতা ছড়িয়েছে, তাতে আমাদের জন্য আশাবহ একটি নতুন অবস্থা তৈরি হবে—এমন আত্মবিশ্বাস নিয়ে তাদের ঘরে ফেরা কঠিন ছিল।
আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে থাকা অপশাসনের কারণে এই তরুণেরা ভবিষ্যতে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবে অথবা তারা তাদের গর্বিত অথচ উদ্বিগ্ন বাবা-মায়ের কাছে কী বার্তা নিয়ে ফিরে যাবে, আমি তা আন্দাজ করতে পারছি না। সৌভাগ্যের বিষয় হলো, এই শিশুদের আন্দোলনে যে একেবারে কোনো লাভ হয়নি, তা নয়। এই আন্দোলনের জের ধরেই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সরকার সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এ-সংক্রান্ত আইনের খসড়া আলোচনার টেবিলে তুলেছে। এ আইনটির খসড়া সাত বছর ধরে স্থবির হয়ে পড়ে ছিল।
অমনোযোগী ড্রাইভিংয়ের জন্য সংঘটিত বহুল আলোচিত সড়ক দুর্ঘটনায় নন্দিত চলচ্চিত্র পরিচালক তারেক মাসুদ ও বিখ্যাত সাংবাদিক মিশুক মুনীরের মৃত্যুর পর আইনটির খসড়া তৈরি করা হয়। ওই ভয়াবহ ও হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনার পর একইভাবে সারা দেশে বিক্ষোভ হয়েছিল। তার পরিপ্রেক্ষিতে তাড়াহুড়ো করে মূল আইনটি বানানো হয়েছিল। কিন্তু দিন শেষে দেখা গেল, ক্ষমতাধর মন্ত্রীদের নেতৃত্বে থাকা পরিবহনমালিক ও শ্রমিক ফেডারেশনগুলোর চাপের মুখে সেই আইন সিন্দুকবন্দী করে রাখা হলো।
আমাদের ছেলেমেয়েরা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সেই সিন্দুক খুলে বিলটি বের করে এনেছে এবং শিগগিরই বিলটি পাসের জন্য পার্লামেন্টে ভোটে যাবে। এর জন্য আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে অবশ্যই ধন্যবাদ জানাতে হবে। দেশের স্বার্থে, বিশেষ করে দেশের শিশুদের স্বার্থে তাঁর এই পদক্ষেপের জন্য তাঁকে অভিবাদন জানাতে হবে। এ আইনটির সম্ভাবনার বিষয়ে যতই সীমাবদ্ধতা থাকুক না কেন, এটি যে বিধিবদ্ধ হয়েছে, সেটিই ইতিবাচক অর্জন বয়ে আনবে। সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের অন্যান্য আইনের মতো এ আইনটির মূল্য অধিকতর প্রতিষ্ঠা পাবে তখন, যখন এটিকে শুধু ঘোষণায় আটকে না রেখে বাস্তব ক্ষেত্রে কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব হবে।
বহু বছরের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা বুঝেছি, প্রথম কোনো কারণে এ ধরনের আইন তৈরির প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল কিংবা কেন বেশির ভাগ আইনই কদাচিৎ যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে—সেসব ভালোভাবে না জেনেই আমরা আইন প্রণয়ন বা পুনর্লেখনে মাত্রাতিরিক্ত সময় ব্যয় করি।
লক্ষণীয় হলো, এই দেশে আইন কার্যকরভাবে প্রয়োগ করার বিষয়ে রাষ্ট্রের অক্ষমতার বিষয়টি আমাদের শিশুরা এই অল্প বয়সেই বোঝার মতো প্রগাঢ় অন্তর্দৃষ্টি অর্জন করতে পেরেছে। তারা এমন এক অভিজ্ঞান অর্জন করতে পেরেছে, যা বেশির ভাগ বড়রা দায় এড়ানোর জন্য এত দিন পাশ
কাটিয়ে এসেছেন।
এই ছেলেমেয়েরা তাদের আন্দোলনে যে প্রধান স্লোগান আমাদের সামনে নিয়ে এসেছে তা হলো, ‘আমরা ন্যায়বিচার চাই’ ও ‘সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত, রাষ্ট্র মেরামতের কাজ চলছে’। তারা আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে, অল্প কিছুসংখ্যক অদক্ষ ও দায়িত্বজ্ঞানহীন চালকই মূল সমস্যা নন, এই সমস্যা আরও গভীরে প্রোথিত। ত্রুটিপূর্ণ শাসনব্যবস্থাই এই সমস্যার মূল উৎস। শিশুরা আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে, আমাদের সরকারব্যবস্থার নজরদারি ও জবাবদিহির অভাব আতঙ্কজনক মাত্রায় নেমে এসেছে। চালকেরা বৈধতার কাগজপত্র ছাড়াই গাড়ি চালাতে পারেন; কারও কাছে যদিও বা কাগজ আছে কিন্তু তাঁদের পেশাগত দক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ, যথাযথভাবে পরীক্ষা দেওয়া ছাড়াই তাঁরা টাকাপয়সা দিয়ে বা অন্য কোনো কায়দায় এসব কাগজপত্র জোগাড় করেছেন।
আমরা এমন এক সমাজে বাস করছি, যেখানে একটি আইন সবার জন্য প্রযোজ্য হয় না। যুগের পর যুগ এই পক্ষপাতমূলক নীতির ওপর দাঁড়িয়ে
আমাদের আইনের শাসন পরিচালিত হচ্ছে। এই চিরন্তন সত্যটি আমাদের ছেলেমেয়েরা সবার সামনে উন্মোচন করে দিয়েছে। একটি বিষয় আমরা সবাই জানি এবং বলা যায়, যা আমাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। সেটি হলো, যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ, ভবন নির্মাণবিধি অথবা ঋণের অর্থ পুনরুদ্ধার করতে যেসব আইন রয়েছে, তা ঠিকমতো প্রয়োগ করা হয় না। একেকজনের ক্ষেত্রে একেকভাবে আইন প্রয়োগ করা হয়। আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর সদস্যরা তাঁদের চাকরির প্রথম দিন থেকেই একচোখা বিচারের বিষয়কে আত্মস্থ করে ফেলেন। ফলে সবার সামনে আইন লঙ্ঘন করার পরও যখন কাউকে ছাড় দেওয়া হয়, তখন আমরা বুঝে নিই এই আইন ভঙ্গকারী ব্যক্তি রাজনৈতিক সুবিধাপ্রাপ্ত ক্ষমতাধর লোক, সুতরাং আইন তাঁর জন্য অন্যদের মতো প্রযোজ্য নয়; তিনি ছাড় পেতেই পারেন।
অসহায় শিক্ষার্থীদের ওপর হেলমেট পরে লাঠি হাতে যেসব যুবক হামলা চালিয়েছেন, তাঁদের পরিচয় নিয়ে কিছু জননেতা অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকেই এসব দুর্বৃত্তকে তাঁদের ভালো করে চেনার কথা। আমার রাজনীতিসংশ্লিষ্ট স্মৃতি থেকে বলতে পারি, অর্ধশতক আগে পাকিস্তান আমলে যখন আইয়ুব খানের শাসন চলছিল, তখন আমরা এই ধরনের অপরাধীদের সহজেই শনাক্ত করতে পারতাম। যখন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন এসব লোকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন না, তখন সহজেই বোঝা যায়, তাঁরা শাসক দলের সহযোগী। আজকের মন্ত্রিসভার সদস্য রাশেদ খান মেনন, মতিয়া চৌধুরী, তোফায়েল আহমেদ, নুরুল ইসলাম নাহিদ, হাসানুল হক ইনু—তাঁরা সবাই আইয়ুব আমলে ছাত্রনেতা ছিলেন। তাঁরা ভালো করেই জানেন, পাকিস্তান আমলে আমাদের ক্যাম্পাসগুলোতে কীভাবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশনের (এনএসএফ) ছেলেরা দাপিয়ে বেড়াত। গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের জন্য যখন তখনকার বীরোচিত ছাত্রনেতারা আন্দোলন–সংগ্রাম করতেন, তখন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের সঙ্গে এনএসএফের কর্মীরা যুক্ত হয়ে তাঁদের ওপর হামলা করতেন। সহিংসতা ছড়াতেন। আমাদের এই নেতারা তাঁদের ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বহু আগেই জেনেছিলেন, এনএসএফ সদস্যরা যত বড় অন্যায়ই করুন না কেন, সরকার তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে না।
একই ধরনের ঘটনা এরশাদ এবং বিএনপির আমলে দেখা গেছে। তখনো আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের ওপর হামলা হয়েছে। হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে পুলিশ যখন নির্বিকারভাবে দাঁড়িয়ে থেকেছে, তখন বোঝা গেছে, ক্ষমতাসীন দলের সদস্যরা ছাড়া আর কারও পক্ষে এভাবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হওয়া সম্ভব নয়।
পাল্টা আঘাতের মুখে পড়লে নিজেদের বাঁচাতে এই গুন্ডাপান্ডাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তা দরকার হয়। নিজেদের কুকীর্তি থেকে দায়মুক্তি পাওয়ার জন্যও তাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দরকার হয়। এমনকি প্রকাশ্য দিবালোকে সংবাদমাধ্যমকর্মীদের সামনে সহিংসতা চালানোর পরও সাজা এড়ানোর সুযোগ পেতে তারা এসব সংস্থার ওপর নির্ভর করে। ক্ষমতাসীন যে রাজনীতিকেরা একসময় গুন্ডাদের দা এবং পুলিশের লাঠির সামনে আন্দোলন করেছেন, তাঁদের সেই অতীত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমরা বুঝতে পারি, যখন দুর্বৃত্তরা পুলিশের সামনে যাকে-তাকে হেনস্তা করে, তখন তাদের আসল পরিচয় কী। একটি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে সহিংসতায় নিয়ে যাওয়া দুর্বৃত্তদের পরিচয় নিয়ে যে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছিল, তা সহজেই দূর করা যেতে পারত। যখন আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে সশস্ত্র গুন্ডাদের মিশে গিয়ে ছাত্রদের ওপর হামলা চালাতে দেখেছি, তখনই প্রমাণিত হয়েছে, তারা ক্ষমতাশালীদের ঘনিষ্ঠ। তারা মুখোশ পরা নাকি হেলমেট পরা ছিল, সেটি আর তখন দেখার বিষয় থাকেনি।
এরপর আমরা দেখলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে। দুঃখজনক হলো, ক্যামেরায় যাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশে থেকে ছাত্রছাত্রীদের ওপর হামলা চালাতে দেখা গেছে, তাদের একজনকেও আটক করা হয়নি। এর আগে একইভাবে সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরার সামনেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ছাত্রছাত্রীদের ওপর ক্ষমতাসীন দলের সংশ্লিষ্ট লোকজনকে হামলা করতে দেখা গেছে। এসব সহিংসতা জনগণের স্মৃতিতে গেঁথে আছে। বেছে বেছে শুধু এই ছাত্রছাত্রীদের (যাঁদের অনেকেই হামলার শিকার হয়েছেন) বিরুদ্ধে নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ঘটনা প্রচ্ছন্নভাবে অন্যায় বলে সবার সামনে প্রতীয়মান হচ্ছে।
আমরা এর আগেও দেখেছি, যখনই কোনো গণ-আন্দোলন হয়, সেই মুহূর্তে নানা ধরনের খেলোয়াড় নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এর মধ্যে ঢুকে পড়ে। স্মরণাতীতকাল থেকে বিরোধী দলগুলো এ ধরনের আন্দোলন থেকে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করে থাকে। অতি জনগুরুত্বসম্পন্ন ইস্যুগুলোকেও তারা সরকারবিরোধী আন্দোলনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কোনো শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলনকে কোনো দুর্বল রাজনৈতিক
দল তাদের দুর্বলতর সাংগঠনিক দক্ষতা দিয়ে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পেরেছে বলে আমার মনে হয় না।
ছাত্রছাত্রীদের বিরুদ্ধে সরকারের সর্বশেষ নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে সাইবার কার্যক্রমের জের ধরে। ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগের জগৎ এমনই এক নতুন জগৎ, যার সঙ্গে আমার একেবারেই জানাশোনা নেই। আমার কোনো ফেসবুক অ্যাকাউন্টও নেই, এটি কীভাবে কাজ করে, সে বিষয়ে আমার পরিষ্কার ধারণাও নেই। তবে আমি এটুকু জেনেছি, একুশ শতকে যোগাযোগ ও তথ্য আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে এটি প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার চেয়েও অনেক শক্তিশালী মাধ্যম। এই সাইবার জগতে সরকারের প্রতিটি কাজ ও উদ্যোগ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়।
এ অবস্থায় সরকারের মাথায় রাখা উচিত, দেশের সব নাগরিক এবং সব ইন্টারনেট ব্যবহারকারী তার বন্ধু নয়; সবাই শত্রুও নয়। তারা নানা ধরনের মন্তব্য করবে। কিছু সরকারের পক্ষে, কিছু বিপক্ষে যাবে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের অধিকাংশই খবর তৈরি করে না; তারা খবর আদান-প্রদান করে। সরকারের মাথায় রাখা উচিত, তার এমন কিছুসংখ্যক সমালোচক আছেন, যাঁদের সরকারি-বেসরকারি কার্যক্রম নিয়ে মন্তব্য করার দীর্ঘ ইতিহাস আছে। তাঁরা তাঁদের বক্তব্যকে সর্বোচ্চসংখ্যক শ্রোতা-পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে চান। কিন্তু সরকারের বিপক্ষে যায় এমন কোনো মন্তব্য করার জন্য তাঁদের সরকারের শত্রু ভাবার কিছু নেই।
আমি বিশ্বাস করি, বিশ্বনন্দিত আলোকচিত্রী শহিদুল আলম এই শ্রেণিতে পড়েন। বহু বছর ধরে তিনি নানা ধরনের সামাজিক আন্দোলনের ছবি তুলেছেন, যা তাঁকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি ও সম্মান এনে দিয়েছে। বাংলাদেশে যাঁরা সচেতন নাগরিক আছেন; এবং যাঁরা শহিদুলের ফটোগ্রাফির সঙ্গে পরিচিত, তাঁরা সবাই জানেন শহিদুল উদার গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিশীল চেতনার একজন মানুষ। সারা জীবন তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে তাঁর শিল্পকর্মকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। একেকটি ছবির মধ্য দিয়ে তিনি যেভাবে একেকটি গল্প বলেন, তা আমার মধ্যে ঈর্ষা জাগায়।
যদি শহিদুল কোনো ঘটনায় আলোড়িত হয়ে ছবি তোলেন এবং সেই ঘটনা প্রশংসার চোখে দেখার মতো না হয় কিংবা তিনি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সরকার সম্পর্কে কিছু মতামত দেন, আমি মনে করি সেটা করার অধিকার তাঁর আছে। এটি তাঁকে সরকারের শত্রু কিংবা রাষ্ট্রদ্রোহী বানাবে না।
অতীতে আমাদের অনেককেই বিভিন্ন সরকার দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়েছিল। কিন্তু সৌভাগ্যের বিষয় হলো, শেষ পর্যন্ত আমাদের মানমর্যাদা অক্ষুণ্ন অবস্থায় ফিরে এসেছে। কিন্তু আমাদের গায়ে এমন তকমা দেওয়া শাসনব্যবস্থা তাদের সুনাম অক্ষত রাখতে পারেনি। বর্তমানে ক্ষমতাসীন থাকা দলটির রাজনৈতিক ঐতিহ্যের প্রতি আজীবন সহানুভূতিশীল একজন হিসেবে আমার শুধু দুঃখ হয় এই দেখে যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া পথপ্রদর্শনমূলক রাজনৈতিক আদর্শ থেকে আমরা বিচ্যুত হয়ে গেছি। বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন সরকারবিরোধী হিসেবে। বহু বছর ধরে তিনি নির্যাতন, স্বেচ্ছাচারী আটকাদেশ, মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক অধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলন করেছেন। মিথ্যা মামলায় জেল খেটেছেন। তিনি এমন এক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে অগণতান্ত্রিক পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, যেখানে এ ধরনের অন্যায়-অবিচার রাষ্ট্র পরিচালনার যন্ত্র হবে না, যেখানে নাগরিকের মত প্রকাশের অধিকারকে দমন করে রাখা হবে না।
এই বৃদ্ধ বয়সে আমার রাজনৈতিক অবস্থানে বড় কোনো পরিবর্তন আনতে পারব না। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে আমি শুধু এই আশাই করতে পারি, তাঁর রাজনৈতিক উত্তরাধিকারীদের হাতে নিজেদের ভুলত্রুটি সংশোধন করার সময় এখনো আছে। পেশিশক্তি দিয়ে জনগণের আন্দোলন দমন না করে তাদের কাতারে এসে দাঁড়িয়ে তাদের ভালোবাসা ও সমর্থন জয়ের সময় এখনো আছে।
আমি মনে করি, সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবাদে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করতে গিয়ে আটক হওয়া সব শিক্ষার্থীকে ছেড়ে তাদের সব ধরনের অভিযোগ থেকে মুক্তি দেওয়া উচিত। কোটা আন্দোলনকারীসহ কিছু শিক্ষার্থীকে জামিনে মুক্তি দেওয়া একটি ইতিবাচক দিক উন্মোচন করেছে। আমি মনে করি, শহিদুলকেও জামিনে মুক্ত হওয়ার বিষয়ে প্রশাসনের সহযোগিতা করা উচিত। শহিদুলকে কারাবন্দী করায় দেশে-বিদেশে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
কোনো এক প্রাচীন ঋষি তাঁর অনুসারী নৃপতিদের উদ্দেশে কয়েকটি বাণী দিয়েছিলেন। সেগুলো আমাদের এই সময়েও প্রাসঙ্গিক। সেগুলো হলো:
সত্যিকারের শত্রুদের থেকে সত্যিকারের বন্ধুদের আলাদা করতে শেখো
শত্রুদের বন্ধুতে পরিণত করার চেষ্টা করো
এটা নিশ্চিত করো, তোমার বন্ধুরা শত্রুতে পরিণত হবে না।

গত ২০ আগস্ট ঢাকা ট্রিবিউন পত্রিকায় প্রকাশিত। ইংরেজি থেকে অনূদিত, ঈষৎ সংক্ষেপিত
রেহমান সোবহান অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান