সোমবার, ২৫ মার্চ, ২০১৯

ওহাবী-সালাফী কারা? সালাফী-মার্কিন সম্পর্ক ওহাবী সালাফীদের জন্মকথা ও ওহাবী রাজতন্ত্র ।


ওহাবী-সালাফী কারা?

(১)
ইসলামের ইতিহাসে খারেজী শিয়াদের উৎপত্তির কয়েক শতাব্দী পর আরেকটি চরমপন্থী বাতিল দলের উৎপত্তি ঘটে সিরিয়ার অধিবাসী ইবনে তাইমিয়ার দ্বারা। প্রথমদিকে তারা আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতভুক্ত হাম্বলী মাযহাবের নামে নিজেদের বদআক্বীদা ও চরমপন্থাকে ঢেকে রাখলেও আস্তে আস্তে তাদের খোলস পাল্টাতে থাকে। তৎকালীন হক্কানী-রব্বানী উলামায়ে কিরাম ইবনে তাইমিয়া ও তার অনুসারীদেরকে মুরতাদ বলে ঘোষণা করেন। এ প্রসঙ্গে বিশ্বখ্যাত মুসলিম পরিব্রাজক ইবনে বতুতা লিখেছে- একদা দামেস্কের জামে মসজিদে ইবনে তাইমিয়া ঘোষণা করেছিল- আল্লাহ আসমান হতে জমীনে নামেন, ঠিক যেভাবে আমি নেমে যাচ্ছি বলে ইবনে তাইমিয়া মিম্বর থেকে নেমে পড়ে। (নাঊযুবিল্লাহ) আল্লাহ পাক মানবসুলভ আকৃতি বিশিষ্ট মতবাদের একজন দৃঢ় বিশ্বাসী হিসেবে (ধহঃযৎড়ঢ়ধড়সড়ৎঢ়যরংঃ) সে কুখ্যাত। তাকলীদ অস্বীকারকারী ইবনে তাইমিয়া তার এক বয়ানে বলেছে- উমর ইবনুল খত্তাব (রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু) জীবনে বহু ভুল করেছেন। আলী ইবনে তালিব (রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু) জীবনে তিনশো ভুল করেছিলেন। (নাঊযুবিল্লাহ) ফলতঃ ইবনে তাইমিয়া একাধিকবার গ্রেফতার হয়ে অতঃপর ৭২৮ হিজরী মতান্তরে ২৭শে সেপ্টেম্বর ১২২৮ ঈসায়ীতে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। তার মৃত্যুর পর তার কুফরী মতবাদগুলো ছাইয়ের নিচে ছাপা পড়া আগুনের মত পড়ে থাকলেও সেই আগুনকে আবার মিল্লাতে মুসলিমার মধ্যে প্রজ্জ্বলিত করে আরবের নজদ প্রদেশের ইবনে আব্দুল ওহাব নামক এক মানব শয়তান। ঐতিহাসিক আব্দুল মওদুদ এ প্রসঙ্গে লিখেন- ‘প্রায় চারশো বছর পরে ইবনে আব্দুল ওহাবের (১৭০৩-১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দ) নেতৃত্বে যে ওহাবী মযহাব (যা বাতিল) প্রতিষ্ঠিত হয়। তার মৌলিক নীতিগুলি ইবনে তাইমিয়ার শিক্ষা থেকেই গৃহীত হয়েছে এ বিষয়ে কোন মতবিরোধ নেই।’ যার উদ্ভব প্রসঙ্গে খোদ হাদীছ শরীফ-এ ভবিষ্যৎবাণী উচ্চারিত হয়েছে। যা বুখারী শরীফ-এর ২য় খ- ১০৫১ পৃষ্ঠায় বর্ণিত আছে এভাবে- “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুয়া করলেন- “আয় আল্লাহ পাক! আমাদের শাম এবং ইয়ামেন দেশে বরকত দান করুন। তখন হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ আরজ করলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম, আমাদের নজদের জন্যও দুয়া করুন। হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শাম এবং ইয়ামেনের জন্য পুনরায় বরকতের দুয়া করলেন। হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ আবারো নজদের জন্য বরকতের দুয়া করার আরজী পেশ করলে হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নজদের জন্য দুয়া করতে অস্বীকার করলেন এবং বললেন, “আমি নজদের জন্য কি করে দুয়া করতে পারি? সেখানেতো ভূমিকম্প, ফিতনা-ফাসাদ এবং শয়তানী দলের উৎপত্তি হবে।” 
মূলতঃ হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ভবিষ্যতবাণী অনুযায়ী ১১১৪ হিজরী কারো মতে ১১১৫ হিজরী মুতাবিক ১৭০৩ ঈসায়ী সালে আরবের নজদ প্রদেশের উয়াইনা অঞ্চলে জন্ম গ্রহণ করে ইবনে আব্দুল ওহাব নজদী। 
(২)
বলাবাহুল্য, ইবনে তাইমিয়ার প্রেতাত্মারূপে ইবনে আব্দুল ওহাব নজদীর জন্ম হলেও বর্তমান সময়ের মাযহাবপন্থী দাবিকারী তাবৎ দেওবন্দী মৌলুভী গং ইবনে তাইমিয়াকে বিরাট এক বুযূর্গ বলেই মনে করে। যেমন বাংলাদেশে দেওবন্দী সিলসিলার অন্যতম আখড়া চট্টগ্রামের পটিয়া খারিজী মাদ্্রাসার মুখপত্র এপ্রিল/০৯ ঈসায়ী সংখ্যায় ‘মহাজীবন’ বিভাগে লিখেছে- ‘ইমাম ইবনে তাইমিয়া ছিলেন ত্রয়োদশ শতকের একজন প্রথিতযশা আলিম, মুহাদ্দিস, ফক্বীহ ও মুজাদ্দিদ।’ (নাঊযুবিল্লাহ)
অথচ ইবনে তাইমিয়ার বদ আক্বীদা বদ আমল ব্যাপকভাবে প্রকাশিত হলে তারই অন্যতম প্রধান ছাত্র বিশ্বখ্যাত মুফাস্সির আল্লামা ইবনে কাছীর রহমতুল্লাহি আলাইহি তার সোহবতকে বর্জন করেন এবং নিজেকে আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতভুক্ত হক্কানী মাযহাবের অন্তর্ভুক্ত করে নেন। সেখানে কি করে দেওবন্দী খারিজীপন্থী পটিয়ার মুখপত্র ইবনে তাইমিয়াকে মুজাদ্দিদ বলে উল্লেখ করলো? মূলতঃ বহু ক্ষেত্রেই বর্তমান দেওবন্দী মৌলুভী গং সউদী রাজতন্ত্রীদের মদদপুষ্ট ইবনে ওহাব নজদীর প্রচারিত আমল আক্বীদার সাথে সাদৃশ্য রাখে। যার ফলেই তারা ইবনে ওহাব নজদীর গুরু ইবনে তাইমিয়াকে মুজাদ্দিদ বলার অপপ্রয়াস পেয়েছে।
উল্লেখ্য, ফতওয়ায়ে শামী, ইশায়াতে হক্ব, ওহাবীদের ইতিহাস, ওহাবীদের উৎপত্তি, মাযহাব কি ও কেন? সাইফুল জব্বার, সাইফুল মাযহাবসহ আরো অসংখ্য কিতাবে ইবনে ওহাব নজদী সম্পর্কে উল্লেখ আছে, “ইবনে আব্দুল ওহাব অত্যন্ত উদাসীন এবং গোঁড়ামী চরিত্রের অধিকারী ছিলো। তাই সে তার হক্কানী পিতা ও ভ্রাতার মতের বিপরীত চলতো এবং প্রায়ই তাদের বিরুদ্ধাচরণ করতো এবং মনগড়া নতুনমত প্রচার করে ফিতনার সৃষ্টি করতো। তার ভ্রান্ত আক্বীদাগুলোর সাথে সেই যামানার হক্কানী-রব্বানী আলিমগণ কোনভাবেই একমত হতে পারেননি। যার ফলে বহু মুত্তাক্বী আলিমদের উপর স্টীম রোলারের ন্যায় অত্যাচার নির্যাতন চালিয়ে তাদের অনেককেই সে শহীদ করে ফেলে। (নাঊযুবিল্লাহ)
১১৪০ হিজরী হতে তার ফিতনা ফ্যাসাদগুলো ব্যাপকভাবে প্রচারিত এবং প্রকাশিত হয় বলে বিভিন্ন কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সে কুফরী ফতওয়া দিয়ে মক্কা শরীফ ও মদীনা শরীফ-এর বহু সম্মানিত স্ত্রী ও কুমারীদের সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হতো এবং তাদের দাস দাসী বানাতো। মসজিদে নববী শরীফ-এর মূল্যবান বিছানা-বাতিগুলো নজদে পাচার করে। আহলে বাইত এবং হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের মাযার শরীফগুলো ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়। এমনকি আন্্ নাবিয়্যুল উম্মী হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মহাপবিত্র রওজা শরীফ ভেঙ্গে ফেলার জন্য একদল নজদীর অনুসারী উদ্যত হলে মহান রব্বুল ইজ্জত আল্লাহ পাক একটি সাপ পাঠিয়ে তাদেরকে চির তরে খতম করে জুব্বুল হুজন জাহান্নামে পাঠিয়ে দেন।”
বলার অপেক্ষা রাখে না, মুরতাদ ইবনে তাইমিয়ার ফেলে যাওয়া কুফরী মতবাদগুলো আরো ব্যাপক কুফরী-শিরকী বেয়াদবী দিয়ে পুনঃসংস্কার করলো ইবনে আব্দুল ওহাব নজদী। যা তার নামের সাথে সম্পর্কযুক্ত হয়ে সারাবিশ্বে কুখ্যাতি লাভ করলো ‘ওহাবী মতবাদ’ তথা ‘ওহাবী আন্দোলন’ নামে। যদিও বর্তমানে ওহাবীরা নিজেদেরকে ধামাচাপা দিতে আহলে হাদীছ, সালাফী নামধারণ করে মুসলিম উম্মাহ্্র মাঝে নতুন করে বিভ্রান্তি ছড়ানোর অপচেষ্টা করে যাচ্ছে।
(৩)
বলাবাহুল্য, আরবের নজদ প্রদেশের ফিতনাবাজ শয়তানের সিং ইবনে ওহাব নজদী সম্পর্কে যেখানে হাদীছ শরীফ-এর সর্বাধিক ছহীহ কিতাব বুখারী শরীফ-এ সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে, যার আক্বীদা আমলের সাথে কোন কালের কোন দেশের আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের কোন হক্কানী-রব্বানী উলামা-মাশায়েখ একমত হননি। সেখানে বর্তমান সউদী রাজতন্ত্রীরা ইবনে ওহাব নজদীর সাথে কি এমন আত্মিক সম্পর্ক বজায় রাখে যার কারণে সারা বিশ্বে ওহাবী মতবাদ প্রচার-প্রসারে সউদী রাজতন্ত্রী সরকারের সর্বোচ্চ মহল পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে? এ প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে বর্তমান প্রজন্মের সচেতন মুসলমানদেরকে ‘ওহাবী নজদী’র উৎপত্তি ক্রমবিকাশ ও আরব জাহানে সউদী রাজতন্ত্রীদের সূচনার ইতিহাস সম্পর্কে সম্যক জানতে হবে। উল্লেখ্য, ইবনে ওহাব নজদীর জন্ম আরবের নজদ প্রদেশের অন্তর্গত উয়াইনা অঞ্চলের তামিম গোত্রের বানু সিনান বংশে। হাম্বলী মাযহাবপন্থী হক্কানী আলিম পিতার ঘরে লালিত-পালিত হলেও পরিণত বয়সে সে নিজেকে খাঁটি আলিম দাবি করে নানারূপ নতুন আক্বীদা পোষণ ও প্রবর্তন করতে আরম্ভ করে এক নব্য ফিরকার সৃষ্টি করে সেটার ইমাম সেজে বসে। মক্কা শরীফ ও মদীনা শরীফ-এর তৎকালীন আলিম উলামাগণ এমনকি স্বয়ং তার পিতা-ভ্রাতা এই নব্য ভ্রান্ত গোলযোগ সৃষ্টিকারী বদআক্বীদার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ করে তাকে বিশেষভাবে অপদস্থ ও অপমানিত করেন। এরপরও পুনঃশক্তি সাহস সঞ্চয় করে ইবনে ওহাব নজদী তার নব্য ফিতনাকে অব্যাহত রাখলো কিভাবে- তারই অজানা রহস্য প্রকাশ পেয়েছে তৎকালীন ব্রিটিশ গুপ্তচর হেমপারের দঈড়হভবংংরড়হ ড়ভ ধ ইৎরঃরংয ঝঢ়ু ধহফ ইৎরঃরংয বহসরঃু ধমধরহংঃ ওংষধস' নামক গ্রন্থে। 
উক্ত স্বীকারোক্তিমূলক গ্রন্থ থেকে প্রতীয়মান হয়, মূলতঃ শয়তানের চর ইহুদী-নাছারারা বুঝতে পেরেছিল মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ অনৈক্য ও সংঘাত সৃষ্টি করতে পারলেই দ্বীন ইসলামের পুনর্জাগরণ ও বিশ্বশক্তি হিসেবে মুসলমানদের উত্থান ঠেকানো যাবে। আর তা করতে হবে ইসলামের মধ্যে ইসলামের নামে নিত্য নতুন মতবাদের প্রকাশ ঘটিয়ে। ক্রুসেড যুদ্ধের পর থেকে এ পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের আধিপত্য থাকাকালীন এ বিষয়ে পরিকল্পনার বাস্তবায়নে চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেয়া হয়। সে অনুযায়ী ১১২২ হিজরী মুতাবিক ১৭১০ ঈসায়ীতে লন্ডন থেকে উক্ত ব্রিটিশ গুপ্তচর হেমপারকে আরো ৯ জন গুপ্তচরসহ মিশর, ইরাক, হিজাজ এবং তুরস্কে পাঠানো হয় যাতে করে অতিসত্বর মুসলমানদের মধ্যে চরম ফিতনা-ফাসাদের সূত্রপাত করা যায়। গুপ্তচরবৃত্তি চলাকালীন ইরাকের বসরায় ইবনে ওহাব নজদীর সাথে হেমপারের প্রথম সাক্ষাত এবং ঘনিষ্ঠতা সৃষ্টি হয়। হেমপার উক্ত গ্রন্থে স্বীকার করে বলেছে যে, “ঐ সময়ই ইবনে ওহাব নজদীর বিভ্রান্তিকর স্বভাব চরিত্র দেখে তাকেই আমাদের (ইহুদী-নাছারাদের) ইচ্ছা পূরণের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি বলে মনোনীত করি। এক পর্যায়ে তাকে গোপনে মদ্যপানে অভ্যস্ত করি এবং মুতা বিবাহেও আবদ্ধ করি।” নাঊযুবিল্লাহ
(৪)
অতঃপর চতুর ব্রিটিশ গুপ্তচর হেমপার লিখেছে- আমি খুব খুশি এবং নিশ্চিন্ত ছিলাম এই কারণে যে, নৈতিকভাবে অধঃপতিত এবং মূর্খ ইবনে ওহাব নজদী একটা নতুন ফিরকা তৈরি করতে যাচ্ছে। যা ইসলামকে ভিতর থেকে ধ্বংস করে দেবে এবং আমি (হেমপার) হচ্ছি নতুন ফিরকার উত্তরাধিকার সৃষ্টির রূপকার।” এ প্রসঙ্গে ‘মৌলবাদের বিশ্বায়ন’ নামক বইয়ে ‘হামফ্রের তবলীগ’ শিরোনামে লিখা হয়েছে- এভাবে মাওলানা সেজে হামফ্রে (হেমপার) ইস্তাম্বুল থেকে দূরে, সমুদ্র ও সীমান্তের সন্নিকটে বসরায় চলে আসে। আরেক মসজিদে আশ্রয় নেয়। এই নূরানী চেহারার ইস্তাম্বুলী মাওলানা এখানে এক সময় তবলীগ তথা ধর্মপ্রচারের নামে স্থানীয় লোকজনদের ধর্মশিক্ষা দিতে শুরু করে। আসলে ধর্মের মূল আকর কুরআন-হাদীছে সাবিত অর্থাৎ  হালাল হিসেবে প্রমাণিত বলে পরিষ্কার বলে দেয়া হয়নি যা তার সবকিছুই বিদ্য়াত-হারাম। জিকির হারাম, নবী রসূলের উছীলা ধরে খোদার কাছে চাওয়া হারাম, তসবী হারাম, মীলাদ হারাম, কবর জিয়ারত হারাম, কাছীদা হারাম। হারাম হারাম।... হামফ্রের পাঁতানো ফাঁদে সরলমতি অনেক হাজিরানে মজলিস পা দিয়ে বসে। তাদেরই মজলিসে যোগ দেয় আরেক মোহাম্মদ অর্থাৎ ইবনে আব্দুল ওহাব নজদী।... ধর্মানুরাগী এই অসাধারণ বালকটির প্রতি নাকি ‘শায়খ মোহাম্মদ’ নামধারী হামফ্রে’র নজর সবিশেষ নিবদ্ধ হয়। (মৌলবাদের বিশ্বায়ন, পৃষ্ঠা ৫৪/৫৬)
হেমপারের উক্ত তথ্য থেকে সহজেই বুঝা গেল ইবনে ওহাব নজদীর শক্তি সাহস সঞ্চয়ের পিছনে পূর্ণমাত্রায় কাজ করছিলো ইহুদী-নাছারাদের সার্বিক সহযোগিতা। ইবনে ওহাব নজদীর তৎকালীন ফিতনা প্রসঙ্গে তার সমসাময়িক আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের অন্যতম ইমাম হযরত আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর সুবিখ্যাত কিতাব ‘রদ্দুল মুহতার’ শরহে দুররুল মুখতারের ৩য় খ-ে উল্লেখ করেন, “খারিজীদের দৃষ্টান্ত এমন যেমন আমাদের যুগের ইবনে ওহাব নজদীর অনুসারীরা নজদ ভূমি থেকে বহির্গত হয়ে পবিত্র হারামাইন শরীফ-এর উপর চড়াও হয়েছে। তারা নিজেদেরকে হাম্বলী হিসেবে প্রচার করে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা নিজেদেরকেই শুধু মুসলমান বলে মনে করে এবং তাদের বিপরীত মতের অনুসারী তাবৎ সুন্নী মুসলমানকে মুশরিক বলে জানে। এমনকি তারা আহলে সুন্নত এবং তদীয় আলিম উলামাগণকে হত্যা করা নিজেদের জন্য হালাল বলে দৃঢ় বিশ্বাস করে।” (নাঊযুবিল্লাহ)
শুধু এতটুকু নয়, বর্তমান ওহাবী-সালাফীদের সাথে বিশেষ সখ্যতা সৃষ্টিকারী দেওবন্দী মৌলভীদের অন্যতম অন্যতম মুরুব্বী মাও. আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী তার ফাইযুল বারী শরহে বুখারীতে লিখেন- প্রকৃত প্রস্তাবে ইবনে ওহাব নজদী ছিল একজন স্বল্প শিক্ষিত লোক। তাই কথায় কথায় কুফরের ফতওয়া দিতো। (নাঊযুবিল্লাহ) এছাড়া ইবনে ওহাব নজদীর কুকীর্তি সম্পর্কে আদ্ দুররুস্ সানীয়া, খুলাসাতুল কালাম, কিতাবুস সাওয়ায়িক ইত্যাদি গ্রন্থেও বিস্তারিত উল্লেখ আছে।
(৫)
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, হাদীছ শরীফ-এর বিশুদ্ধ কিতাব বুখারী শরীফ-এর শরাহ ‘ফাইযুল বারীতে’ মুসান্নিফ বলেন- ‘প্রকৃত প্রস্তাবে ইবনে ওহাব নজদী ছিল অতি স্বল্প শিক্ষিত লোক। তাই কথায় কথায় সে কুফর শিরকের ফতওয়া দিত।’ এরপরও দেওবন্দী মৌলভীদের এদেশীয় মাদ্রাসাসমূহের অন্যতম সংগঠন ‘বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া’ এর নেছাবভুক্ত একটি আকাঈদের কিতাবে লিখা হয়েছে- ‘ওয়াহহাবী’ মুহাম্মদ ইবনে আবদিল ওয়াহাব কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত একটি ইসলামী সম্প্রদায়ের নাম। (নাঊযুবিল্লাহ) এখন তাহলে ওয়াহহাবীরা যদি ইসলামী সম্প্রদায়ভুক্ত হয়, তাহলে অনৈসলামী বাতিল কারা? অথচ ইতিহাস সাক্ষী ইবনে ওহাব নজদী ইহুদী-নাছারাদের গুপ্তচর হেমপার কর্তৃক প্রশিক্ষিত হয়ে ১৭২০ ঈসায়ীতে হজ্জে গিয়ে হজ্জের অনেক শরীয়তসম্মত কার্যাবলীকে বিদ্্য়াত, শিরক, কুফরী আখ্যায়িত করে বিরাট ফিতনার সৃষ্টি করে। তখন সুন্নী, তুর্কি সুলতান কর্তৃক নজদীকে সেখান থেকে বহিষ্কার করা হয়। ইহুদী-নাছারাদের গুপ্তচরদের সহযোগিতায় এ সময় সে নজদের প্রত্যন্ত অঞ্চল আদ দারিয়ার তৎকালীন শাসক ইবনে সউদকে তার নব্য ওহাবী মতবাদে দীক্ষিত করে এবং তারই আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থাকে। 
সুন্নী তুর্কি সুলতানদের বাধা-বিপত্তি মোকাবেলায় তারা উভয়ে বিভিন্ন লোভ লালসা দেখিয়ে ইবনে ওহাব নজদীর জন্মস্থান নজদের আরেকটি অঞ্চল উয়াইনার শাসক উসমান ইবনে মুয়াম্মারকেও ওহাবী মতবাদে কবজা করে। এ সময় তার কুফরীমূলক ওহাবী আন্দোলন আরো জোরদার হয় তার বিয়ের মাধ্যমে। যদিও এ বিয়ের পূর্বে সে আরো বিয়ে এমনকি মুতা বিয়েও করে। কারো কারো মতে ইবনে ওহাব নজদী ইবনে সউদের মেয়েকে বিয়ে করে। অন্যদের মতে তার জন্ম স্থান উয়াইনার শাসক উসমান ইবনে মুয়াম্মার এর আপন ফুফু জাওহারা বিনতে আব্দুল্লাহ নামক চতুর মহিলাকে বিয়ে করে। ঐতিহাসিকদের মতে, ইবনে সউদের মেয়ে কিংবা ইবনে মুয়াম্মারের ফুফু যার সাথেই হোক না কেন ইবনে ওহাব নজদীর উক্ত চতুর বিবির প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ উভয় প্রভাবেই নজদের দারিয়াহ এবং উয়াইনা প্রদেশে সর্বপ্রথম প্রশাসনিক আদেশে ‘ওহাবী মতবাদ’ গ্রহণ করা তখন সর্বসাধারণের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়। 
(৬)
এ প্রসঙ্গে ওহাবী ঐতিহাসিকরা লিখেছে- ‘ইবনে ওহাব নজদী শুধুমাত্র দ্বীনি মুবাল্লিগই ছিলেন না বরং ওর সাথে সাথে তিনি একজন ক্ষমতাসম্পন্ন শাসনকর্তাও ছিলেন। তবে তিনি শাসনকার্য নিজ হাতে গ্রহণ করতে অস্বীকার করে বরং ইবনে সউদ নজদীর হস্তে অধিনায়কত্বের বাইয়াত গ্রহণ করে। খুলাফায়ে রাশিদীন-এর সময় বড় বড় ছাহাবায়ে কিরাম যেরূপ পরামর্শদাতা ও সাহায্যকারী ছিলেন তদ্রুপ শাসক ইবনে সউদের নিকট ইবনে ওহাব নজদী তেমনটিই ছিলেন। দু’জনের চিন্তাধারার মধ্যে সর্ব দিক দিয়ে পূর্ণমাত্রায় সমতা বিদ্যমান ছিল। শাসন কার্যের দায়িত্ব যদিও ইবনে সউদের উপর ন্যস্ত ছিল তথাপি ইবনে ওহাব নজদীর পরামর্শ ছাড়া প্রশাসনিক কার্যে কোন রদবদল করা যেত না।’ 
অতঃপর ইবনে ওহাব ও ইবনে সউদ উভয়ে মিলে সুন্নী তুর্কি সালতানাতের উৎখাতে জঙ্গি ওহাবী মতবাদী আন্দোলন বেগবান করে তোলে। ১৭৭৩ ঈসায়ীতে তারা রিয়াদ দখল করে। ওহাবী মতবাদ কোন নতুন মতবাদ নয় বরং এটা হাম্বলী মাযহাবের সংস্কারমূলক আন্দোলন‘ এমন ধোঁকায় ফেলে দলে দলে আরবের বেদুঈন যুবকদেরকে ওহাবী মতবাদে দীক্ষিত করে জঙ্গি প্রশিক্ষণ দিতে থাকে। এ অবস্থায় ১২০৬ হিজরী মুতাবিক ১৭৯২ ঈসায়ী কারো মতে ১৭৮৭ ঈসায়ীতে ইবনে আব্দুল ওহাব নজদীর মৃত্যু হয়। তার প্রধান সহযোগী ওহাবী সাম্রাজ্যের কর্ণধার ইবনে সউদ ও নজদীর ভাবশিষ্য প্রেতাত্মারা মিলে ওহাবী মতবাদ বিস্তারে একের পর এক সুন্নী শাসিত এলাকা দখল করতে থাকে। এভাবে ১৭৯৭ ঈসায়ীর মধ্যে সুন্নী তুর্কি সালতানাতের অধিকাংশ এলাকা ওহাবীদের জবরদখলে চলে যায়। ১৮০৩ সালে প্রথমে মক্কা শরীফ এবং ১৮০৪ সালে পবিত্র মদীনা শরীফ ওহাবীরা দখল করে। এ অবস্থায় সারাবিশ্বের সুন্নী মুসলমানদের জোর সমর্থনে ১৮১১ সালে মিশরের সর্বশেষ তুর্কি সুলতান মুহম্মদ আলী পাশা ওহাবী শাসনকে উৎখাত করে প্রথমে মদীনা শরীফ ও ১৮১২ সালে মক্কা শরীফ পুনঃরুদ্ধার করেন। ১৮১৮ ঈসায়ী মুতাবিক ১২৩৩ হিজরীতে ওহাবীদের রাজধানী আদ দারিয়াহ ধ্বংস করা হয়। ইতঃমধ্যে ওহাবী রাজতন্ত্রের জনক ইবনে সউদ মারা যায়। তার ছেলে আব্দুল্লাহ ইবনে সউদকে বন্দি করে শিরñেদ করা হয়। মূলতঃ এভাবেই গজিয়ে উঠা ওহাবী সাম্রাজ্য ছাইয়ের নিচে চাপা পড়া আগুনের মত আপাতত নির্বাপিত হয়ে যায়।
(৭)
আল্লাহ পাক কালামুল্লাহ শরীফ-এ ইরশাদ করেন, “কাফির, মুশরিকরা চায় ঈমান আনার পর কি করে পুনরায় মুসলমানদেরকে কুফরী শিরকীতে নিমজ্জিত করা যায়।” ১৮১৮ সালে আরবের সুন্নী মুসলমানরা ওহাবীদের কুফরী প্রতাপ থেকে মুক্ত হলেও ইহুদী-নাছারাদের মদদে ইবনে আব্দুল ওহাব নজদী কর্তৃক প্রচারিত এবং ইবনে সউদ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ওহাবী মতবাদের প্রচার-প্রসার বিভিন্ন নামে বেনামে অতি গোপনে বিভিন্ন কলা-কৌশলে চলতে থাকে। আবার অনেক কাট্টা ওহাবী সুন্নীরূপ ধারণ করে  সুন্নী সালতানাতের বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে ঢুকে পড়ে। অপরদিকে গোপনে জঙ্গি ওহাবী আন্দোলনের শিক্ষা-দীক্ষা বিভিন্ন পাহাড় পর্বতের কিনারায় প্রতিশোধের উন্মাদনায় অব্যাহত থাকে। তারা ইহুদী-নাছারাদের সার্বিক সহযোগিতা নব নবরূপে পেতে থাকে। ওহাবীবাদের ধর্মীয় ফিতনায় ইবনে ওহাব নজদীর বংশধররা এবং জঙ্গিপনা পরিচালনায় ইবনে সউদের বংশধররা নেতৃত্ব দিতে থাকে। 
এ প্রসঙ্গে ‘মৌলবাদের বিশ্বায়ন’ গ্রন্থে লিখা হয়েছে- ‘মুসলমানদের ভিতর ইসলামের বিশ্ব দৃষ্টি সঞ্জাত মূলনীতির প্রতিপক্ষে এই ইহুদীবাদ সঞ্জাত মৌলবাদী ধারণা চালু করে দেয়াটা উপনিবেশবাদী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের এক প্রধান স্ট্যাটেজিক কাজ হয়ে দাঁড়ায়। এর জন্য বিশেষ করে তখনকার প্রধানতম উপনিবেশবাদী সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ব্রিটেন তার গোয়েন্দা বিভাগ দ্বারা প্রাচ্যে সাংস্কৃতিক পর্যায়ে এক চোরাগোপ্তা যুদ্ধ শুরু করে। অষ্টাদশ শতাব্দীর ব্রিটিশ গোয়েন্দা হামফ্রে (হেমপার) আর বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের ব্রিটিশ গোয়েন্দা লরেন্স এ বিষয়ে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন বলে নানা রিপোর্টে বর্ণিত। লরেন্স পরবর্তীকালে সিনেমা ইত্যাদির মাধ্যমে ‘লরেন্স অব অ্যারাবিয়া’ বলে খ্যাতি অর্জন করেন।’ অর্থাৎ হেমপারের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত সউদী ওহাবী রাজত্ব সুন্নী তুর্কি সুলতানদের দ্বারা ধ্বংস হলে ইহুদী, মুশরিক, নাছারা চক্র বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে লরেন্স নামক আরেক গোয়েন্দাকে দায়িত্ব দিয়ে পাঠায় যাতে ওহাবী রাজত্ব পুনরুদ্ধার হয়। মূলতঃ লরেন্সের গোয়েন্দা তৎপরতায় পুনরায় ওহাবী মৌলবাদী জঙ্গিরা সংঘটিত হয়ে প্রায় ছিয়াশি (৮৬) বৎসর পর ইবনে সউদ-এর পৌত্র আব্দুল আযীয ইবনে আব্দুর রহমান ওরফে আব্দুল আযীয ইবনে সউদ ১৯০১ সালে রিয়াদ এবং ১৯০৪ সালে তারা পবিত্র মক্কা শরীফ ও মদীনা শরীফ পুনঃদখল করে। অল্প সময়েই জিদ্দা হিজাজসহ গোটা আরব ওহাবী শাসনের আওতাভুক্ত করে। যা ওহাবী রাজতন্ত্রের জনক ইবনে সউদের নামানুসারে নামকৃত আজকের সউদী আরব। যেখানে ওহাবী মতবাদসহ ওহাবী রাজত্ব পুরুষানুক্রমে আজো চলছে। 
(৮)
এ প্রসঙ্গে মুহম্মদ আসাদ নামক এক নও মুসলিম যে নব্য ওহাবী রাজা আব্দুল আযীয ইবনে সউদের গোয়েন্দা পর্যবেক্ষক হিসেবে কাজ করেছিল। সে তার সেই পর্যবেক্ষণের আত্মজীবনী ঞযব জড়ধফ ঃড় গধপপধ নামক গ্রন্থে লিখেছে- আধুনিককালের ইতিহাসের সবক’টি রেঁনেসা আন্দোলন যেমন ভারতীয় উপমহাদেশে আহলে হাদীছ আন্দোলন, আফ্রিকায় ‘সেনুসী’ আন্দোলন, জামালুদ্দীন আফগানী ও অন্যান্যদের প্রচেষ্টা সবকিছুই উৎস খুঁজে পাওয়া যাবে আঠারো শতকের ইবনে আব্দুল ওহাব নজদীর মধ্যে। ইবনে আব্দুল ওহাব নজদীর পর থেকে তার অনুসারীরা যে নিজেদেরকে কেবল দ্বীনের যোদ্ধাই মনে করেছে তা নয় বরং দ্বীন ইসলামের একমাত্র মালিক মুখতার বলেও গণ্য করে আসছে। ‘কেবল আমিই ঠিক পথে আছি’ এই অহমিকা বোধের নিম্নভূমিতে লুটিয়ে পড়েছে আঠারো শতকের শেষের দিকে ইবনে ওহাব নজদীর গড়া ওহাবী মতবাদের ইবনে সউদের রাজত্ব।’ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী কাফির মুশরিকদের দ্বারা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত ইবনে ওহাব নজদীর অনুসারী আধুনিক সউদী রাজতন্ত্রের বাদশাহ আব্দুল আযীয ইবনে সউদ সম্পর্কে মুহম্মদ আসাদ তার ‘ঞযব জড়ধফ ঃড় গধপপধ' বইতে লিখেছে- “এমন এক ব্যক্তির কথা যে ইবনে সউদের নেতৃত্বে তীব্র বিশ্বাসী এবং বাদশাহ’র শাহী জিন্দেগীর সবচেয়ে কঠিন বছরগুলোতে সুখে দুঃখে, বিপদ আপদে বাদশাহর সঙ্গী ছিলেন; সেই ব্যক্তি আব্দুল আযীয ইবনে সউদের প্রসঙ্গে বলেন, “সেই প্রথম দিকের বছরগুলোতে... আমাদের মনে হয়েছিল আব্দুল আযীয ইবনে সউদ এক নতুন মূসা। যিনি তার কাওমকে জাহিলিয়াত এবং অবক্ষয়ের বন্ধন থেকে মুক্ত করে নিয়ে যাবেন প্রতিশ্রুত ইসলাম (ওহাবীবাদ)এর ভূমিতে। কিন্তু তিনি যখন তার কাওম এবং তার ভবিষ্যতকে ভুলে গিয়ে কায়িম হয়ে বসলেন নবার্জিত আরাম-আয়েশ এবং বিলাসিতা নিয়ে, তখন আমরা ভয়ে শিউরে উঠে দেখতে পেলাম ইনি এক ফেরাউন...।’ এই নব্য ওহাবী ফিরাউনের পূর্বপুরুষ ইবনে সউদ পেয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের সার্বিক সহযোগিতা। আর সে পেয়েছে অতিরিক্ত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী ইহুদী-নাছারাদের সার্বিক সাহায্য। সে মার্কিনীদেরকে ওহাবী মতবাদ জিন্দাকরণের প্রভু হিসেবে বরণ করে নিয়েছে। এই বন্ধুত্বকে স্থায়ী করতে ১৯৪৫ সালের মার্চে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট এবং সউদী ওহাবী বাদশা আব্দুল আযীয ইবনে সউদ একটি গোপন চুক্তিতে সাক্ষর করে। ঐতিহাসিকরা লিখেছেন- ‘ঐ গোপন চুক্তিকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী এবং সউদী রাজতন্ত্রী ওহাবীদের মধ্যে দীর্ঘকালীন সামরিক ভৌগোলিক কৌশলগত মৈত্রীর দাসখত বলা যায়।’ বর্তমানে এটা কোন গোপন বিষয় নয়, কারণ মার্কিনীরা এবং সউদী রাজতন্ত্রী ওহাবীরা যে দহরম মহরম তথা বিশেষ সম্পর্ক বজায় রাখছে তা সারা বিশ্বে চিরন্তন সত্য অর্থাৎ টহরাবৎংধষ ঃৎঁঃয-এ পরিণত হয়েছে।
(৯)
সউদী রাজতন্ত্রীদের মদদপুষ্ট ওহাবীদের কুকীর্তির বয়ানে অনেক বিষয়ই উত্থাপন করা যায়। এ পথভ্রষ্ট ফিরকাটির উৎপত্তির পিছনে নিহিত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হলো- ইসলাম ও মুসলমানদের আক্বীদা বিশ্বাস ও আদর্শের বিরুদ্ধে বিশেষ করে আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের অস্তিত্বকে মিটিয়ে দেয়ার কু-পরিকল্পনা। এরপরও শায়খুল হদছ আযীযুল হকের খেলাফত মজলিসের বর্তমান আমীর কথিত বুলবুলি মৌলভীর মাদ্্রাসার ওস্তাদ, দেওবন্দ ফারেগ এক মৌলভী প্রণীত ‘ইসলামী আক্বীদা ও ফিরাকে বাতিলা’ নামক পুস্তকে লিখা হয়েছে- “ওয়াহাবী ও সুন্নী তথা আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের মধ্যে আক্বীদাগত কোন পার্থক্য নেই। আমাদের দেশে ওয়াহাবী সুন্নী প্রশ্ন নিয়ে যে কোন্দল পরিলক্ষিত হয় এটি মূলতঃ রাজনৈতিক। আক্বীদাগত এর কোন ভিত্তি নেই।” (নাঊযুবিল্লাহ) আরো লিখা হয়েছে- ‘মুসলিম সমাজে অনুপ্রবিষ্ট শিরক বিদাত প্রভৃতি নানা কুসংস্কার ও সর্বপ্রকার শোষণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে ইবনে ওহাব নজদী সংগ্রাম করে জয়যুক্ত হয়েছিলেন। তাকে জনসমক্ষে হেয় করার জন্য ওয়াহাবী শব্দের আবিষ্কার করে এবং এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করলো যে, সাধারণ মানুষ ওয়াহাবী বলতে ধর্মদ্রোহী মনে করতে লাগলো।’ (ফিরাকে বাতিলা- পৃ: ২২২)
পাঠক! আপনারা সহজেই বুঝতে পারছেন দেওবন্দীরা হাক্বীক্বতে সউদী ওহাবীদের বিশেষ খয়ের খাঁ। যার ফলে সউদী ওহাবী তথা ইবনে আব্দুল ওহাব নজদীর অনুসারীদের কুকীর্তি তুলে ধরলে দেওবন্দীদের আঁতে ঘা লাগে। মূলতঃ অনেক আক্বীদা আমলেই দেওবন্দী মৌলভী গং সউদী রাজতন্ত্রী ওহাবীদের সাথে সাদৃশ্য রাখে। সেজন্য তারা সউদী ওহাবীদেরকে খারাপ বলে কি করে তাহলে যে প্রস্রাবের ছিটা উল্টা দিকেই গড়াবে। তবে ওহাবীরা নিজেদেরকে লুকাতে যতই দেওবন্দী, তবলীগ, মওদুদী, সালাফী, আহলে হাদীছ কিংবা মোহাম্মদী নামক সাব এজেন্ট তৈরি করুক না কেন তারা তাদের কুপরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিভিন্ন কর্মকা-ের দরুন সারা বিশ্বের মুসলমানদের নিকট ‘ওয়াহাবী সম্প্রদায়’ বলেই চিহ্নিত হয়েছে।
যদিও তারা ‘ওহাবী’ শব্দে সম্বোধন করাকে গালি হিসেবে ধরে নেয়। আবার ক্ষেত্র বিশেষে নিজেদেরকে ওহাবী বলতেও গর্ববোধ করে। যেমন এক ওহাবী ঐতিহাসিক লিখেছেÑ “ওহাবিয়তকে ইসলাম হতে সম্পূর্ণ পৃথক একটি মতবাদ রূপে চালাবার যে হীন প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে, এ দিক থেকে এই ওয়াহাবী নাম দেয়া খুবই আপত্তিকর। কিন্তু এ অপব্যাখ্যা ও অপবাদের দিক হতে চোখ ফিরিয়ে নিলে বাস্তবে এ নামে কোন দোষই চোখে পড়বেনা। কারণ, ‘ওয়াহাব’ আল্লাহ পাক-এর একটি নাম। আমাদের আন্দোলন যেহেতু তাওহিদকে প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সে হিসেবে ওয়াহাবী বললে এ নামে সম্বোধন সার্থক হয়।” (নাঊযুবিল্লাহ)। অথচ তাওহীদ এর সাথে একইভাবে কেউ রিসালাতপন্থী না হলে তাকে মুসলমানই বলা যাবে না। বিপদ আঁচ করতে পেরে তাই সউদীরা ইদানিং ওহাবী পদবী মারাত্মকভাবে বর্জন করে চলে। অথবা এমনও হতে পারে সারা বিশ্বের মুসলমানরা যেহেতু প্রতিনিয়ত সউদি আরবে সমবেত হয় তাই তাদের থেকে লুকানোর জন্যই এমনটি করা হয়। 
(১০)
পর্যবেক্ষক মহলের মতেÑ যেহেতু ওহাবী মতবাদ বর্তমানে একটা চিহ্নিত বাতিল মতবাদ হিসেবে সাব্যস্ত। যার ফলে মুসলমানদেরকে ওহাবী মতবাদে গুমরাহ করতে বিশেষ বেগ পেতে হয়। তাই তারা বিকল্প হিসেবে আহলে হাদীস ও সালাফী এ দু’নামে পরিচয় দিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। তাদের প্রচারপত্রসমূহে তারা বুক ফুলিয়ে বলেÑ ‘যারা কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ-এর অনুসরণ করে তারাই আহলে হাদীছ। চার মাযহাবের ইমামগণের জন্মের পূর্বে একটি মাত্র জামাত ছিল।’ তবে সউদী ওহাবীরা নিজেদেরকে সাধারণতঃ সালাফী বলেই পরিচয় দেয়। অনুরূপ মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপ আমেরিকা এবং আফ্রিকার ওহাবীরা নিজেদেরকে সালাফী বলে দাবি করে। ভারতীয় উপমহাদেশের ওহাবীরা যেহেতু খুব বেশি চিহ্নিত তাই তারা এখানে আহলে হাদীস বলেই নিজেদের প্রচার করে। ক্ষেত্র বিশেষে কাদিয়ানীদের আহমদী দাবির বিপরীতে এরা নিজেদেরকে মোহাম্মদী বলেও জাহির করে।
উল্লেখ্য, আহলে কুরআন নামধারীরা যেমন বাতিল ফিরক্বা, তদ্রুপ আহলে হাদীছ নামধারী ওহাবীরাও বাতিল ফিরক্বা। মূলতঃ কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ-এর যারা খাঁটি অনুসারী তাদেরকে বলা হয় ‘আহ্লে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত’। তাদেরকে আহলে হাদীস বলা ওহাবীদের মনগড়া বানানো মিথ্যা অপবাদ ছাড়া কিছুই নয়। মিথ্যা অপবাদ দিতে গেলে যখন তারা ধরা পড়ে তখন তারা বলে আমরা মূলতঃ সালফে সালেহীনদের অনুসারী। তাই আমরা সালাফী। যা সউদীতে বেশি দেখা যায়, অথচ সালফে সালেহীনগণ পবিত্র কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ এবং ইজমা-ক্বিয়াস চারটিরই সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম-পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরণ অনুকরণ করতেন। 
অপরদিকে সালফে সালেহীনগণ সমস্ত হাদীছ শরীফই মানতেন বুঝতেন এবং অনুসরণের হাক্বীক্বত সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান রাখতেন। তাহলে ওহাবীরা না হাক্বীক্বতে হাদীছ শরীফ-এর অনুসারী না সালফে সালেহীনদের অনুসারী কোনটাই তো না। বরং সুশৃঙ্খল আমল আখলাক নিয়ম-নীতি তথা ছহীহ্্ আক্বীদার অবাধ্য হয়ে মনগড়া চলার কারণে মুহাক্কিক-মুদাক্কিক উলামা-মাশায়েখগণ সউদী রাজতন্ত্রীদের মদদপুষ্ট এ বিভ্রান্ত সম্প্রদায়কে সাধারণত লা-মাযহাবী ওহাবী ফিরক্বা বলেই অভিহিত করে থাকেন। 
উল্লেখ্য, ওহাবীদের কর্তৃক ভারতীয় উপমহাদেশকে ‘আহলে হাদীছ’ নাম নিয়ে সাধারণ ধর্মপ্রাণ সুন্নী মুসলমানদের বিভ্রান্তির পেছনেও যে ব্রিটিশ বেনিয়া ইংরেজদের শক্ত মদদ ছিল, সেটারই প্রামাণ্য দলীল প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন কিতাবপত্রে।
(১১)
উল্লেখ্য, উপমহাদেশে আহলে হাদীছ নামধারী লা-মাযহাবী ওহাবী ফিরকাটিকে বরাবরই দেওবন্দী মৌলুভীরা ইবনে ওহাব নজদীর ‘ওহাবী সম্প্রদায়’ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে উপস্থাপন করে। এরপরও উপমহাদেশের মুহাক্কিক, মুদাক্কিক উলামায়ে কিরাম এবং তাবৎ সুন্নী মুসলমানরা আহলে হাদীছ নামধারী গায়রে মুকাল্লিদ, লা-মাযহাবীদেরকে ওয়াহাবী বলেই সম্বোধন করেন। এ প্রসঙ্গে ‘আল ইরশাদ ইলা সাবীলির রাশাদ’ নামক পুস্তকে লিখা হয়েছে- ‘তারা যদিও নিজেদেরকে আহলে হাদীছ বা মোহাম্মদী বা মুওয়াহহেদী বলে প্রচার করে থাকে, কিন্তু আহলে হকের অনুসারীগণ তাদেরকে গায়রে মুকাল্লিদ লা-মাযহাবী ওয়াহাবী বলেই অভিহিত করে থাকেন।’ (পৃ: ১৩)
উল্লেখ্য, ওয়াহাবী গালি থেকে বাঁচার জন্য তারা নওয়াব সিদ্দিক হাসান সাহেবের যুগ পর্যন্ত নিজেদেরকে ‘মুওয়াহিদীন’ বা তাওহীদপন্থী কিংবা ইবনে ওহাব নজদীর নামানুসারে ‘মোহাম্মদী’ বলে পরিচয় দিতো। ১৮১৮ সাল থেকে উপমহাদেশে তারা নিজেদেরকে সর্বপ্রথম আহলে হাদীছ নামে পরিচয় দেয়া শুরু করে। এরপরও যখন তারা ‘ওয়াহাবী’ কলঙ্ক মোচন করতে পালো না তখন ১৮৮৬ সালে ‘এশাআতুস্ সুন্নাহ’ পত্রিকার সম্পাদক লা-মাযহাবী আবু সাঈদ মুহাম্মদ লাহোরী তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের কাছে তার পত্রিকার মাধ্যমে আবেদন করে যে, ওয়াহাবী শব্দটি আহলে হাদীছ নামে খ্যাত দলটির ব্যাপারে যারা সর্বদা ইংরেজ সরকারের নেমক হালাল এবং কল্যাণকামী এবং এ বিষয়টি সুপ্রমাণিত। অথচ সরকারি কাগজপত্রে তা স্বীকৃত নয়। সেই মর্মে এই দলের লোকজন অত্যন্ত আদব ও বিনয়ের সাথে সরকারের নিকট আবেদন করছে যে, সরকারিভাবে তাদের জন্য ওহাবী শব্দটি বর্জনপূর্বক তাদের জন্য ‘আহলে হাদীছ’ শব্দটি ব্যবহার করা হোক। এ বিষয়টি দরখাস্ত আকারে মৌলভী মুহাম্মদ হুসাইন বাটালভী পাঞ্জাব গভর্নমেন্টের নিকট পেশ কর। অতঃপর তৎকালীন পাঞ্জাবের লেফটেন্যান্ট গভর্নর দরখাস্ত মঞ্জুর করে ওহাবীদেরকে ‘আহলে হাদীছ’ নামে সরকারিভাবে রেজিস্ট্রি করে। তবে ইবনে ওহাব নজদী কর্তৃক ওহাবীজম চালুর পেছনে যেমন ব্রিটিশ গোয়েন্দা হেমপারের বিষয়টি ফাঁস হয়েছে, ১৯ শতকে এসে ফের কিভাবে ব্রিটিশ-মার্কিন গোয়েন্দা লরেন্সের মাধ্যমে সউদী ওহাবী রাজত্ব পুনরুজ্জীবিত হয় সেটাও যেমন প্রকাশ পেয়েছে তদ্রুপ ভারতীয় উপমহাদেশে ওহাবীরা কিভাবে আহলে হাদীছ আন্দোলন প্রচারের সূচনা করে সেটাও ফাঁস হয়েছে- অতি সম্প্রতি ‘মৌলবাদের বিশ্বায়ন’ নামক গ্রন্থে।
 (১২)
উল্লেখ্য, ‘মৌলবাদের বিশ্বায়ন’ নামক বইয়ের গ্রন্থকার ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের মাঝে আহলে হাদীছ ফিরকা চালুর প্রেক্ষাপট তুলে ধরে লিখেছেন- “এসবই হচ্ছিল ১৯ শতকের প্রথমার্ধে। এরই পথ ধরে ঐ প্রথমার্ধের শেষ পাদে খোদ ব্রিটিশরা তাদের মৌলবাদ ‘অ্যাসেম্বল’ করা কাজে বেশ সাহসী আরেকটি পদক্ষেপ নেয়। তা হলো ১৮৫০-এর আশেপাশে এক ‘হাদীস প্রচার’ আন্দোলন। এক রিপোর্ট অনুযায়ী কলকাতার অ্যাংলিকান গির্জার বিশপ (পাদ্রী) হাদীছ প্রচারে খুব আগ্রহী হয়ে পড়েন। ভূতের মুখে রাম নাম শুনলে একটু চমকে উঠতে হয় বৈকি! তিনি নিজের বা অ্যাংলিকান গির্জার গাটের পয়সা খরচ করে বেশ কিছু হাদীছ অনুবাদ করান ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানীয় ভাষায়। তারপর জনা চল্লিশেক তালেব ইলেম-ফারসিতে, তালেবান (মাদ্্রাসা ছাত্র) ভাড়া করে, ২ টাকা থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত মাসিক বেতন ধার্য করে। সেকালে এ খুব বেশি বড় বেতনই বলতে হবে।.... একজন তালেব ইলেমের এত বেতন পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু আজকাল যেমন নানা বিদেশী ‘বেসরকারি সংস্থা’ স্থানীয়ভাবে যা বেতন কল্পনাতীত তাই দিয়ে দেয়- তেমনি ‘বেসরকারি সংস্থা’ অ্যাংলিকান গির্জাও তাই দিল। কারণ? বেতনভূকদের খুব জরুরী এবং ঝুঁকিপূর্ণ একটি কাজ করতে হবে। কাজটি হলো যার যার এলাকায় গিয়ে অনুবাদ করা ‘হাদীস’গুলো গ-মূর্খ সাধারণ মুসল্লীদের শিখিয়ে দিতে হবে। কিন্তু তাদের ‘হাদীস’ বিশ্লেষণের পদ্ধতিতে ‘মজহাব’ শিখানো যাবে না মোটেই।... একই বিষয়ে পরস্পর বিরোধী মনে হওয়া সব হাদীস (যা অ্যাংলিকান গির্জার পাদ্রি অনুবাদকৃত) শিখে সাধারণ মানুষ যাতে হাদীছ অনুসরণের নামে একে অন্যকে কাটতে ছোটে (যেমনিভাবে বাংলাদেশে জেএমবি নাম আহলে হাদীস নামধারী জঙ্গিদের তা-ব সংঘটিত হয়েছে) তারই ষড়যন্ত্র। এতে উপনিবেশবাদী আগ্রাসীদের স্বার্থানুকূলে স্থানীয় জনসমাজে উচ্ছৃঙ্খলতা হবে।... ভারতবর্ষে ব্রিটিশ পাদ্রী সূচিত এই ধর্মনাশা আন্দোলনটিকে উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে, ব্রিটিশ সরকারের এক বিশেষ আদেশ বলে তাদের ‘হাদীস ওয়ালা’ (আহলে হাদীস) বলে রেজিস্ট্রি করা হয়। মুসলমানের ধর্ম, ব্রিটিশদের রেজিস্ট্রি করা, বিশ্বাসযোগ্যই বটে!” (পৃ: ৮৮-৯০)
পাঠক! গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ভারতীয় উপমহাদেশে আহলে হাদীস ফিরকার ক্ষেত্রেই যে শুধুমাত্র ব্রিটিশদের মদদ পরিকল্পনা ছিল তা নয়, বরং সউদী ওহাবীদের আক্বীদা-আমলের সাথে অনেক ক্ষেত্রে সামাঞ্জস্যশীল উপমহাদেশের দেওবন্দী, কাদিয়ানী, মওদুদী, ছয় উছূলী তাবলীগী, রেজাখানী ইত্যাদি ফিরকার উৎপত্তির পিছনেও বিধর্মী বিজাতি ব্রিটিশদের শক্ত ইন্ধন এবং মদদ ছিল। নতুবা এ সমস্ত ফিরকা আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের চিরন্তন আক্বীদা-আমলের খিলাফ আক্বীদা-আমল পোষণ করে কেন এবং সেগুলো প্রচার প্রসারেও এত মরিয়া কেন- সত্যানুসন্ধানীদেরকে এটা ভালভাবে বুঝতে হবে।
(১৩)
আহলে হাদীছ-সালাফী নামধারী ওহাবীদের উৎপত্তি এবং এর কারণ সম্পর্কে ব্রিটিশ গুপ্তচর হেমপার তার স্বীকারোক্তিমূলক ডায়েরী ‘ঈড়হভবংংরড়হ ড়ভ ধ ইৎরঃরংয ঝঢ়ু ধহফ ইৎরঃরংয বহসরঃু অমধরহংঃ ওংষধস’-এ বিস্তারিত উল্লেখ করে; যা ইতোমধ্যে পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিত হয়ে সউদী রাজতন্ত্রী ওহাবীদের গোঁমর ফাঁস করে দিয়েছে। তবে এটির সবচেয়ে বিশুদ্ধ, সহজ-সাবলীল টীকাসহ অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে পত্রস্থ হয়েছে হযরত মুজাদ্দিদে আ’যম মুদ্দা জিল্লুহুল আলী প্রতিষ্ঠিত আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের একমাত্র দলীলভিত্তিক মুখপত্র মাসিক আল বাইয়্যিনাত শরীফ-এ। এছাড়া তুর্কি ভাষায় রচিত মুহম্মদ আইয়ুব সাবেরি পাশার ‘মিরাত আল হারামাইন’ কিতাবটি ভ্রান্ত ওহাবী মতবাদের উপর একটি তথ্য-প্রমাণভিত্তিক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। এটিও তাজদীদী মুখপত্র আল বাইয়্যিনাত শরীফ-এ ধারাবাহিকভাবে অনূদিত হচ্ছে। এই সমস্ত প্রামাণ্য কিতাবপত্রে সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে যে, ওহাবী মতবাদের জন্মই হয়েছে দ্বীন ইসলামের বিকৃতি সাধনের জন্য, মুসলমানদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টির জন্য এবং ধাপে ধাপে মুসলমানদের বেঈমান, বেয়াদব করে জাহান্নামের অতল গহ্বরে পাঠানোর জন্য। 
শুরু থেকেই ওহাবীদের বয়ান বিবৃতি কার্যকলাপে এ বিষয়টি ফুটে উঠেছে। তাই এই বিষয়টি সবসময় মনে রাখতে হবে যে, আহলে হাদীছ, সালাফী কিংবা মোহাম্মদী নামধারীরাই হলো মূল ওহাবী ফিরকা অন্যরা বিশেষ করে দেওবন্দী, তবলীগী, মওদুদীরা হলো তাদের শাখা-প্রশাখা। কোন্ কোন্ আক্বীদা-আমলে এরা সকলে একই শ্রেণীভুক্ত যেটা পরবর্তিতে আলোকপাত করার আশা রাখি ইনশাআল্লাহ।
সউদী রাজতন্ত্রীদের মদদপুষ্ট এই আহলে হাদীছ-সালাফী নামধারী লা-মাযহাবী ওহাবী ফিরক্বাটি যে অপকর্মটি সর্বপ্রথম করে তা হলোÑ তারা আল্লাহ পাক এর যমীনের সর্বশ্রেষ্ঠ বান্দাগণের পবিত্র মাযার শরীফগুলোর উপর ক্ষুধার্ত কুকুরের ন্যায় জঙ্গি আক্রমণ চালায়। পবিত্র মাযার শরীফ-এ সুন্নত-এর নিয়তে সমবেত হয়ে যিয়ারত করা, ফাতেহা পাঠ করে ইছালে ছওয়াব করা, তাদের মহান উছীলা দিয়ে দোয়া করা ইত্যাদি নেক আমলগুলোকে কুফরী শিরক বিদয়াত ফতওয়া দিয়ে এই বাতিল ফিরকার প্রতিষ্ঠাতা ইবনে ওহাব নজদী উয়াইনার শাসক উসমান ইবনে মুয়াম্মার-এর নেতৃত্বে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত প্রায় ৬ শতাধিক ওহাবী জঙ্গিদের নিয়ে সর্বপ্রথম বিশিষ্ট ছাহাবী হযরত যায়েদ ইবনে খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম-এর মাযার শরীফ-এর উপর চড়াও হয়। ইবনে ওহাব নজদীর নির্দেশে তার সাঙ্গপাঙ্গরা ভয় আতঙ্কে যখন মাযার শরীফ ভাঙতে সাহস পাচ্ছিল না, তখন ইবনে ওহাব নজদী নিজেই অগ্রসর হয়ে স্বহস্তে পবিত্র মাযার শরীফ-এর গম্বুজ ভাঙা শুরু করে। তার দেখাদেখি তার জঙ্গি অনুসারীরাও ভাঙা শুরু করে। এক পর্যায়ে মাযার শরীফকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়। (নাঊযুবিল্লাহ মিন যালিক)
(১৪)
ইবনে ওহাব নজদীর চেলা সউদী আমীর দলবল দিয়ে কারবালায় আক্রমণ চালিয়ে সেখানকার বিশ হাজার অধিবাসী ও যিয়ারতকারীকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। একই ধারাবাহিকতায় রমাদ্বান শরীফ-এ আব্দুল আযীয ইবনে সউদ-এর ওহাবী বাহিনী পবিত্র মদীনা শরীফ দখল করার কয়েকদিন পর ৮ই শাওয়াল তারিখে পবিত্র মাযার শরীফগুলো গুড়িয়ে দেয়। (নাঊযুবিল্লাহ)
অথচ এই পবিত্র জান্নাতুল বাকী হলো- ইসলামের ইতিহাসে সর্বপ্রথম মাযার শরীফসমূহের স্থান। স্বয়ং হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মুবারক নির্দেশে হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ এ পবিত্র কবরস্থান স্থাপন করেন। এমনকি পবিত্র জান্নাতুল বাকীর মর্যাদা-মর্তবা ফাযায়িল-ফযীলত প্রসঙ্গে আন নাবিয়্যুল উম্মি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পক্ষ থেকে একাধিক হাদীছ শরীফ বর্ণিত রয়েছে। পবিত্র জান্নাতুল বাকীতে হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর একাধিক পবিত্রা আহলিয়া আলাইহিমুস্্ সালাম, সম্মানিত শাহজাদা হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম, সম্মানিতা শাহজাদী, সাইয়্যিদাতুন্ নিসা হযরত ফাতিমা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা, লখতে জিগার আহলে বাইতের সম্মানিত হযরত ইমাম হাসান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত ইমাম যাইনুল আবিদীন রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত ইমাম বাকির রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত ইমাম জাফর ছাদিক্ব রহমতুল্লাহি আলাইহিসহ অনেক ছাহাবী, তাবেয়ী, ইমাম-মুজতাহিদ, আউলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম, হযরত আম্বিয়া আলাইহিমুস্্ সালামগণের মাযার শরীফ ছিল (সুবহানাল্লাহ)। পবিত্র জান্নাতুল বাকীতে আনসার ছাহাবীদের মধ্যে সর্বপ্রথম হযরত আসআদ ইবনে যাররাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এবং মুহাজির ছাহাবীদের মধ্যে সর্বপ্রথম হযরত উসমান ইবনে মাযউন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে সমাহিত করা হয়। এত বরকতময় স্মৃতিধন্য রহমতের স্থান হবার কারণে স্বাভাবিকভাবেই সারা বিশ্বের মুসলমানগণ বরকত লাভে উছীলা কামনায় সুন্নত-এর নিয়তে পবিত্র জান্নাতুল বাকীতে সমবেত হতো। 
কিন্তু দুরাচার, বে-দ্বীন, পথভ্রষ্ট লা-মাযহাবী ওহাবী সম্প্রদায় এটা সহ্য করতে না পেরে পুণ্যভূমি জান্নাতুল বাকীর উপর অত্যাচার চালিয়ে তা মাটির সাথে সমান করে নিদর্শনসমূহ বিনষ্ট করে দেয়। সউদি রাজতন্ত্রীর যে সমস্ত শ্রমিক নামধারী ওহাবী কুলাঙ্গার ঘৃণ্যভাবে এ ধ্বংস কাজে অংশ নেয় তাদের প্রত্যেককে এক হাজার রিয়াল পারিশ্রমিক দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়। (নাঊযুবিল্লাহ মিন যালিক) 
(১৫)
এ প্রবন্ধে পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, সউদী রাজতন্ত্রের জনক ইবনে সউদের সময় ইবনে ওহাব নজদীর একদল জঙ্গি অনুসারী পবিত্র রওজাতুন্ নূর ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপর চড়াও হতে চাইলে খোদায়ী গযব স্বরূপ এক সাপ এসে তাদেরকে দংশন করে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। পরবর্তীতে ১৩৪৪ হিজরীতে আব্দুল আযীয ইবনে সউদের নেতৃত্বে পবিত্র জান্নাতুল বাকীর মাযার শরীফসমূহ ধ্বংস করার পর সারা বিশ্বের মুসলমানদের তীব্র রোষাণলের ভয়ে পবিত্র রওজাতুন নূর ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপর হাত তোলা থেকে তারা বিরত থাকে। তার বদলে বরং একদল পাষ- নির্দয় ওহাবী চেলাকে হাতে লাঠি ধরিয়ে দিয়ে কুল কায়িনাতের লক্ষ্যস্থল এই মহান রওযা শরীফ-এ সার্বক্ষণিক দাঁড় করিয়ে রেখেছে, যাদের একমাত্র কাজই হলো- আশিক্বে রসূল যিয়ারতকারীদেরকে অশ্রাব্য ভাষায় গালি গালাজ ও লাঠি-পেটা করে মহান রওজা শরীফ-এর আদব-পবিত্রতায় আঘাত করা। (নাঊযুবিল্লাহ)
উল্লেখ্য, আলীশানভাবে পবিত্র রওযা শরীফ ও তার সংলগ্ন সবুজ গম্বুজ অক্ষত রাখা প্রসঙ্গে সউদী রাজতন্ত্রী ওহাবীদের দালালরা প্রচারপত্রে উল্লেখ করে এভাবে- ‘আমরা এ গম্বুজটিকে মসজিদের একটি গম্বুজ বলেই জানি। শুধু এতটুকুই নয়, সউদী ওহাবীদের এদেশীয় দালাল শায়খুল হদছের মাদ্্রাসার প্রধান মুফতে এ প্রসঙ্গে লিখেছে- বাইরে কবর দিলে লোকেরা তাঁর (নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কবরকে ইবাদতের স্থান বানিয়ে ফেলবে এ আশঙ্কা না থাকলে তাঁকে বাইরে কবর দেয়া হতো’। (নাঊযুবিল্লাহ মিন যালিক) (সূত্র: অপসাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও মিল্লাতে মুসলিমা, পৃষ্ঠা-৩৮)
নূরে মুজাস্সাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হেরেম বা রওযা শরীফ-এর মানহানী করতে এদের অপচেষ্টার অন্ত নেই। হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে- “যে ব্যক্তি হজ্জ সম্পাদন করলো, কিন্তু মহান রওযাতুন্্ নুর ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যিয়ারত করলো না সে মূলতঃ বেয়াদবী করলো।” এ কারণে প্রত্যেক হাজীকেই যিয়ারতের জন্য পবিত্র মদীনাতুল মুনাওয়ারায় যেতে হয়। (চলবে)
(১৬)
সউদি রাজতন্ত্রী ওহাবীরা ছলেবলে কৌশলে পবিত্র রওজা শরীফ জিয়ারত বন্ধ করার জন্য বিভিন্ন ফন্দি-ফিকির আরম্ভ করেছে। প্রথমতঃ তারা মহান রওজা শরীফ যিয়ারত সংক্রান্ত সমস্ত হাদীস শরীফকে জয়ীফ এবং জাল বলে বিভ্রান্তিমূলক অপপ্রচার চালানো আরম্ভ করেছে। এমনকি পবিত্র রওজা শরীফ যিয়ারত করা হজ্জের কোন অংশ নয় বলেও দাবি করছে। ইদানিং হজ্জের সময় ৮ দিনের বেশি পবিত্র মদীনা শরীফ-এ অবস্থান করা নিষিদ্ধ করেছে। অদূর ভবিষ্যতে হজ্জের সময়
পবিত্র রওজাতুন্্ নূর ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিয়ারতের জন্য পবিত্র মদীনাতুল মুনাওয়ারা যাওয়া বন্ধ করে দেয় কিনা সেটাই চিন্তার বিষয়। কারণ লা-মাযহাবী ওহাবীরা তাদের প্রচারপত্রে আবু দাঊদ শরীফ-এর একটি হাদীছ শরীফ-এর বিকৃত মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়ে লিখেÑ “কবর পূজা বন্ধ করার জন্য রসূল (সাঃ) এমনকি তার নিজের কবরের চতুর্দিকে বাৎসরিক অথবা মৌসুমি সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছেন।” (নাঊযুবিল্লাহ)
এমন ব্যাখ্যার মাধ্যমে তারা হজ্জের সময় পবিত্র রওজা শরীফ যিয়ারতের নিষিদ্ধতা প্রমাণ করতে চায়। শুধু এতটুকুই নয়, সউদী রাজতন্ত্রীদের মদদপুষ্ট দুর্ধর্ষ লা-মাযহাবী ওহাবী প্রচারকরা এও লিখেছেÑ “যে মসজিদের ভিতর পরে কবর স্থাপন করা হয়েছে সেই মসজিদ থেকে কবর সরিয়ে ফেলতে হবে।... রসূলের (সাঃ) কবরের চতুর্দিকে প্রতিবন্ধকতা [সুসজ্জিত দরজা জানালা এবং সবুজ গুম্বজ ও গিলাফকে উদ্দেশ্য] স্থাপন করা সত্ত্বেও এখনও ভ্রান্তি সংশোধন করার প্রয়োজন রয়েছে। কেউ যাতে ঐ কবরের কাছে নামায আদায় করতে না পারে অথবা মসজিদের ভিতর হতে সেটিকে না দেখতে পারে সেজন্য আবারো দেয়াল উঠিয়ে মসজিদ হতে কবরকে আলাদা করা উচিত।” (নাঊযুবিল্লাহ) সউদি রাজতন্ত্রী ওহাবী কর্তৃপক্ষকে এমনই কুপরামর্শ দিয়েছে জ্যামাইকাতে জন্মগ্রহণকারী কানাডায় বড় হওয়া অবশেষে ওহাবী মতে দীক্ষিত আবু আমিনাহ ফিলিপস নামক কুলাংগার তার ‘ঞযব ঋঁহফধসবঃধষং ড়ভ ঞধযিববফ' নামের গ্রন্থে।
(১৭)
সউদি রাজতন্ত্রী লা-মাযহাবী ওহাবী সম্প্রদায় কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ-এর অপব্যাখ্যা দ্বারা তাদের কুকীর্তিগুলো হালাল করার চেষ্টা করলেও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত-এর চার মাযহাবের দলীল আদীল্লাহ দ্বারা তাদের কু-কর্মগুলো সম্পূর্ণরূপে ইসলামী শরীয়তবিরোধী বলে প্রমাণিত হয়। যার ফলে তারা জোরে-শোরে মাযহাব চতুষ্টয়-এর বিরুদ্ধে আবোলতাবোল প্রলাপ বকতে শুরু করে। তারা উলিল-আমর ইমাম মুজতাহিদগণের তাকলীদ করা, যে কোন একটি মাযহাবকে মেনে চলা অত্যন্ত ঘৃণ্য বিদয়াতী মুশরিকী কাজ বলে প্রলাপ বলা শুরু করে। যেমন তারা লিখেছেÑ “চারশত হিজরীর পর থেকেই জাতীর ভাগ্যাকাশে সেই অব্যর্থ দুর্বিষহ আভিশপ্ত গ্লানি চেপে বসেছে। যারা কোন ব্যক্তি বিশেষের তরীকা মাযহাব কোন দলের বা পথের অনুসরণ  করে তারা কাফির, মুশরিক, বিদয়াতী, গুমরাহ ও জালেম। তাদের জন্য মহাশাস্তি। তাদের বাচাঁর একমাত্র পথ হলো মাযহাব তরীকা ইত্যাদি বিদয়াতি কার্যকলাপ চিরতরে পরিহার করে তওবা করা (নাউযুবিল্লাহ)।” 
কতবড় কুফরীমূলক মিথ্যা অপবাদ! অথচ আহলে হাদীছ নামধারী এ সমস্ত লা-মাযহাবী ওহাবীরা যাকে ভারতরতœ-ভারতগুরু বলে সম্বোধন করে সেই রইসুল মুহাদ্দেসীন হযরত শ্হা ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর ‘আকদুল জাইয়্যেদ’ নামক কিতাবে চার মাযহাবের তাক্বলীদ করার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে লিখেনÑ “এই চার মাযহাবের তাকলীদ ইখতিয়ার করার মধ্যে অনেক মুসলিহাত আছে এবং এই গুলির বিরুদ্ধাচরণ করার মধ্যে অনেক মুসিবত আছে। কয়েকটি কারণে আমি এই কথা বলতেছি। যখন সব মাযহাব বিলুপ্ত হয়ে শুধু চার মাযহাবই থাকল তখন এই চার মাযহাবের অনুসরণ করা মানেই মুসলমানদের বৃহত্তম দলের অন্তর্ভুক্ত থাকা আর উক্ত চার মাযহাবের অনুসরণ হইতে বিমুখ হওয়া মানেই বৃহত্তম মুসলিম উম্মাহ হইতে খারিজ হইয়া যাওয়া।’ রঈসুল মুহাদ্দেসীন, মুজাদ্দিদে যামান হযরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর ফতওয়া মুতাবিক আহলে হাদীছ নামধারী লা-মাযহাবী ওহাবীরাই মুসলিম উম্মাহ থেকে খারিজ হয়ে কাফির মুশরিক বিদ্য়াতী, গুমরাহ ও জালিম সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে।
(১৮)
উল্লেখ্য, স্বয়ং মুজাদ্দিদে যামান, রঈসুল মুহাদ্দিসীন, ভারতরতœ হযরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলবী রহমতুল্লাহি আলাইহি নিজে খুব ভালভাবেই হানাফী মাযহাবের অনুসরণ-অনুকরণ করতেন। অথচ মিথ্যাবাদী ওহাবীরা তাঁর ‘আল ইনসাফ’ নামের কিতাবের কথা বিকৃত করে অপবাদ দিয়ে থাকে যে, তিনি নাকি বলেছেনÑ ‘যে ব্যক্তি চার মাযহাবের ইমামগণের কথাকে বিনা দলীলে গ্রহণ করে, সে কুরআন হাদীছ-এর উপর নির্ভর করলো না।’ 
শুধু এতটুকু নয়, কুখ্যাত লা-মাযহাবী ওহাবীজনকের ইমাম তাকীউদ্দীন ইবনে তাইমিয়া ‘আলকাযা মিনাল ইনসাফ’ গ্রন্থে ফতওয়া দিয়েছেÑ “যে ব্যক্তি কোন নির্দিষ্ট ইমামের তাকলীদ ওয়াজিব বলে ঘোষণা করবে, তাকে তওবা করানো হবে। যদি তওবা না করে তাকে হত্যা করা হবে; কারণ তারা মুশরিকের অন্তর্ভুক্ত। (নাঊযুবিল্লাহ) এ রকম জঘন্য ফতওয়া দিয়ে যুগে যুগে সউদী রাজতন্ত্রী ওহাবী জঙ্গিরা আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত-এর সুদৃঢ় মুকাল্লিদ ইমামগণের উপর অত্যাচার নির্যাতন চালিয়েছে, তাদেরকে স্বদেশ থেকে বহিষ্কার করেছে। নাগরিক সকল সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে তাদেরকে গুম করেছে এই সউদী রাজতন্ত্রী ওহাবী সরকার। কারণ তারা চার মাযহাবের যে কোন একটিকে অনুসরণ করা ফরয ওয়াজিব হওয়ার উপর ইজমায়ে উম্মতকে সাদরে গ্রহণ করেছেন এবং তার উপর আমলে ইস্তিকামত থেকেছেন। তারা লা-মাযহাবী ওহাবীদের মিথ্যা তোহমত, জুলুমÑনির্যাতন, ভয়Ñভীতি রক্তচক্ষুকে পরোয়া করেননি। বরং আহলে সুন্নত ওয়াল জমায়াত-এর আক্বীদা আমলকে সুদৃঢ়ভাবে লালন-পালন প্রচার করেছেন এবং পথভ্রষ্ট ওহাবী লা-মাযহাবী সম্প্রদায়ের জালে আবদ্ধ হওয়া থেকে উম্মাহকে হিফাযত করেছেন। 
আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত-এর এমন ইমামদের শানেই হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছেÑ ‘আমার উম্মতের একটি দল সর্বদা হক্বের উপর সাহায্যপ্রাপ্ত হয়ে টিকে থাকবে। কারো অপমান অত্যাচার তাদের কোন ক্ষতি সাধন করতে পারবে না। যতক্ষণ  না আল্লাহ পাক-এর নির্দেশে কিয়ামত সংঘটিত হবে।’ এই হাদীছ শরীফ-এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী যুগে যুগে হক্কানী-রব্বানী ওলীআল্লাহ, ইমাম-মুজতাহিদগণের আগমনের ধারাবাহিকতায় বর্তমানে আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত-এর দিক দিশারী একমাত্র লক্ষ্যস্থল ইমাম হলেন বাংলার যমীনে আবির্ভূত হযরত মুজাদ্দিদে আ’যম মুদ্দা জিল্লুহুল আলী। উনার সীমাহীন ইলমি ফায়েজ তথা বেলায়েত কামালতের দাপটে সউদী রাজতন্ত্রীদের মদদপুষ্ট ওহাবী সম্প্রদায় কতটুকু জাহিল গুমরাহ মিথ্যাবাদী প্রতারক এবং দ্বীন ইসলামের মাঝে ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টিকারী সেটাই পরবর্তিতে তুলে ধরার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
(১৯)
উল্লেখ্য, মাযহাব মানা তথা কোন ইমামের তাকলীদ করা প্রসঙ্গে কাট্টা ওহাবী দালাল নাসীরুদ্দীন আলবানি লিখেছেÑ “আমরা কেনই বলতে পিছপা হব, নিশ্চয়ই মুসলিম ইমামগণের (মাযহাবের ইমামগণের) ওমুক ইমাম কোন মাসয়ালাতে ইজতিহাদে বা তার রায়ে ভুল করেছেন? অর্থাৎ ছহীহ হাদীছ না জানা অথবা না বুঝার কারণে ইমামগণ ভুল করতেই পারেন এবং করেছেন।”
এমনটিই  বলতে চাচ্ছে গুমরাহ নাসীরুদ্দীন আলবানি। অথচ আলবানির ওহাবী মতপথের আরেক শিষ্য লিখেছেÑ ‘আবু হানীফাহ (রঃ) কখনই মনগড়া কিছুই বলেননি, কেননা তিনি হাদীসের বিরুদ্ধে কোন কথা বলতেন না।’ এ ব্যক্তির কথানুযায়ী ইমামে আ’যম হযরত আবু হানিফা রহমতুল্লাহি আলাইহি সবকিছুই ছহীহ হাদীস মুতাবিক বলতেন এবং করতেন। তাহলে গুমরাহ আলবানির কথানুযায়ী তিনি ভুল করেন কিভাবে? এদিকে আরেক লা-মাযহাবী ওহাবী লিখেছেÑ ‘যারা শুধু কুরআন ও সহীহ হাদীস মান্য করেন তারা হলেন প্রকৃত মুসলিম তথা আহলে হাদীস। আর আহলে হাদীসগণ দ্বীন ইসলামে পরবর্তিতে সৃষ্ট কোন মাযহাব, তরীক্বা দল বা মতকে মান্য করেন না। কারণ যাদের সম্পর্ক কোন মাযহাবের সাথে তারা মুসলিম হতে পারে না।’(নাঊযুবিল্লাহ) 
এ জাতীয় কুফরী ফতওয়াই তাবৎ লা-মাযহাবী ওহাবীরা তাদের পত্র-পত্রিকা বই-পুস্তকে অনবরত লিখে যা”্ছ।ে আর সেগুলো প্রচার-প্রসারে অগণিত অর্থ দিয়ে মদদ যোগাচ্ছে সউদী রাজতন্ত্রী ওহাবী সরকার। তাদের ফতওয়া মুতাবিক মাযহাবের সাথে সম্পর্ক রাখলে এবং কোন মাযহাবের ইমাম-এর তাকলীদ তথা অনুসরণ করলে যদি বে-দ্বীন মুশরিক হতে হয় তাহলে ইবনে ওহাব নজদীর ফায়সালা কি হবে? কারণ নজদীর জীবনীতে উল্লেখ করা হয়েছেÑ ‘একবার দারইয়ার ওহাবী শাসক ইবনে সউদের নিকট মক্কার ‘শরীফ গালিব ইবনে মাসাইদ’ নামক এক ব্যক্তি পত্র লিখে যেÑ ‘বাহাস ও মুনাযারার জন্য যেন একজন ওহাবী আলেমকে মক্কায় পাঠানো হয়। তখন ইবনে ওহাব নজদী আব্দুল আযীয আল হুসাইন নামক এক ওহাবীকে মক্কায় পাঠায়। সাথে মক্কার আলেমদের প্রতি একখানা ছল-চাতুরিপূর্ণ পত্রও প্রেরণ করে।’
(২০)
পবিত্র মক্কা শরীফ-এর ওলামা-মাশায়েখদের প্রতি ইবনে ওহাব নজদী লিখেছেÑ আমরা আপনাদেরকে প্রকৃত সংবাদ দেয়া জরুরী মনে করছি। অন্যথায় আপনারাও হয়ত আমাদের বিরুদ্ধাচরণে লেগে যাবেন। অতএব, আমরা প্রেরিত পত্রে ঘোষণা করে দিচ্ছি যে, আমরা বিদয়াতী নই। আমরা যারা মাসয়ালার ইমাম আহমদ বিন হাম্বলের অনুসরণ করে থাকি এবং ইজমার দ্বারা ছাবিতকৃত মাসয়ালায় ইজমার বিরোধিতা করাটা আমরা অবৈধ মনে করে থাকি।” ইবনে ওহাব নজদীর পত্রের এ বক্তব্য থেকে বাহ্যত বুঝা যায়, সে হাম্বলী মাযহাবের একজন কট্টর মুকাল্লিদ। যেমনি করে বিভিন্ন ফতওয়া বক্তৃতা দ্বারা তার গুরু ইবনে তাইমিয়াও প্রথমে নিজেকে প্রকাশ করেছিল হাম্বলী মাযহাবের মুকাল্লিদ হিসেবে। কিন্তু এসবই ধোঁকা এবং আহলে হক্বের মাঝে বিভ্রান্তি ছড়ানোর কুটকৌশল মাত্র। কারণ ইবনে তাইমিয়া ও ইবনে ওহাব নজদী যদি সত্যিই তাকলীদ করাকে গুরুত্ব দিত এবং হাম্বলী মাযহাবের অনুসরণ করতো, তাহলে তাদের তাবৎ অনুসারী এবং সউদী রাজতন্ত্রী ওহাবী সরকার কেন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের চার মাযহাব এবং তাকলীদের বিরুদ্ধে এত অপপ্রচারে নেমেছে। আসলে মুসলমানদের গণরোষ থেকে রেহাই পেতে ইবনে ওহাব নজদীগং সাময়িকভাবে মাযহাবের ইমামের তাকলীদের আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। নতুবা তাদের সামাগ্রিক কর্মকা-ে সুস্পষ্টরূপেই প্রমাণিত হয়, তারা কাট্টা লা-মাযহাবী ওহাবী নামক বাতিল সম্প্রদায়। ইজমায়ে উম্মত দ্বারা সাব্যস্ত চার মাযহাবের তাকলীদের বিরুদ্ধে ইদানিং তারা যেভাবে উঠে পড়ে লেগেছে তা খ-ন করা আমাদের জন্য সত্যই দুঃসাধ্য হয়ে যেত যদি না এ ফিতনা যুগে তাশরীফ আনতেন হযরত মুজাদ্দিদে আযম মুদ্দা জিল্লুহুল আলী। সউদী রাজতন্ত্রী ওহাবী সরকারের দাপটের মুখেও একমাত্র উনার মুবারক কলমী জিহাদ তথা ইল্মী জিহাদের উছীলায় আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের চার মাযহাবের আলীশান ঐতিহ্য পুনঃরুদ্ধার করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন