বুধবার, ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯

হুই উইঘুরের ইতিহাস


৬৫০ খ্রিষ্টাব্দে ইসলামের তৃতীয় খলিফ হজরত ওসমান (রা.) চীনা সম্রাটকে ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে সেখানে একটি প্রতিনিধি দল পাঠান। জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত ১০ সাহাবির অন্যতম সদস্য হজরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন। চীনের প্রাচীন তাং বংশীয় নথিপত্রের আলোকে এটা সুস্পষ্ট যে, চীনে ইসলামের আবির্ভাবের সূচনা হয়েছিল সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাসের ওই সফরের মধ্য দিয়ে। ইসলামের প্রতি অনুরাগের নিদর্শনস্বরূপ সম্রাট ইউং ওয়েই চীনে মসজিদ নির্মাণের আদেশ দেন, যা ছিল চীনে প্রতিষ্ঠিত প্রথম মসজিদ। ১৪০০ বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও ক্যান্টন শহরের ওই সমৃদ্ধ মসজিদ স্মারক মসজিদ হিসেবে আরও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
গত কয়েক যুগ ধরে নানা কারণে বহির্বিশ্বে চীনের পরিচিতি পেয়েছে মুসলিমবিদ্বেষী হিসেবে। দেশটির মুসলিম নাগরিকদের ওপর চালানো দমন-পীড়নের জন্য বরাবরই চীন সমালোচিত হয়ে আসছে। বিশেষ করে জিনজিয়াং প্রদেশে বসবাসরত তুর্কিভাষী উইঘুর মুসলিমরা চীনা সরকারের ব্যাপক নির্যাতনের শিকার। তাই মুসলিমবিদ্বেষ পরিচিতি মুছে ফেলতে চীনের রাজধানী বেইজিং থেকে ৬০০ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত ইনচুয়ান শহরটিকে ‘বিশ্ব মুসলিম শহরে’ রূপ দেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট সরকার। শহরটি চীনা হুই মুসলিম শাসিত নিংজিয়া প্রদেশের রাজধানী। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রায় ৩৫০ কোটি ডলার ব্যয়ে শহরটিতে মসজিদ সদৃশ রাজকীয় ভবন, আরবি অক্ষরে লিখিত পথনির্দেশিকা এবং এক হাজার এক আরব্য রজনির অনুকরণে আলোকসজ্জাসমেত থিম পার্ক নির্মাণ করছে চীন। আরব দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে চীনা-আরব ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে গুরুত্ব দিয়ে এ থিম পার্কটি তৈরি করছে চীন সরকার।
চীনে দুটি বড় মুসলিম গ্রুপ রয়েছে। একটি হলো জিনজিয়াংয়ে উইঘুর এবং অপরিচিত হুই। চীনা জনসংখ্যার বিশাল সাগরে তারা স্রেফ কয়েক ফোঁটা পানি। ১ কোটি করে লোকসংখ্যা উভয় গোষ্ঠীর। আকারে তাইওয়ানের সমান। কিন্তু উইঘুররা যখন নির্যাতিত হচ্ছে, তখন হুইরা সমৃদ্ধ হচ্ছে।
ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা দেখতে পাইÑ যাদের বলা হয় হুই মুসলমান, তাদের পূর্বপুরুষদের পারস্য, সিরিয়া, ইরাক, আনাতোলিয়া প্রভৃতি জায়গা থেকে ধরে আনা হয়েছিল চীনে, কাজ করার জন্য। চীনে এরা বিয়ে করে হান কন্যা। ফলে উদ্ভব হয় হুইদের। এরা দেখতে প্রায় হানদেরই মতো। কিন্তু হানদের সঙ্গে এক হয়ে যাননি। বজায় থেকেছে সামাজিক স্বাতন্ত্র্য। হুইরা খুবই নিষ্ঠাবান মুসলমান। তারা আরবিতে কোরআন পাঠ করেন। ছেলেমেয়েদের নাম রাখেন প্রধানত আরবিতে। হুইরা বাইরে হানদের মতো মান্দারিন ভাষায় কথা বললেও বাড়িতে যে ভাষায় কথা বলেন, তাতে থাকতে দেখা যায় অনেক আরবি শব্দ। হুইরা সারা চীনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। তবে তারা বিশেষভাবে বাস করে উত্তর চীনের কান্সু প্রদেশে। কান্সুকেই তারা প্রধানত নিজেদের দেশ বলে মনে করেন।
অন্যদিকে উইঘুর হচ্ছে তুর্কি বংশোদ্ভূত মুসলমানদের একটি গ্রুপ। পূর্ব ও মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এদের বসবাস। উইঘুর মুসলমানদের মোট সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ১৩ লাখ ৭০ হাজার। এর মধ্যে চীনের জিনজিয়াং প্রদেশেই বাস করে ৮৫ লাখের মতো। হুনানসহ অন্যান্য চীনা প্রদেশ ও রাজধানী বেইজিংসহ বিভিন্ন নগরীতেও অল্পসংখ্যক উইঘুর বাস করে। এছাড়া কাজাখস্তান, কিরগিজিস্তান, উজবেকিস্তান, তুরস্ক, রাশিয়া, তাজিকিস্তান, পাকিস্তান ও মঙ্গোলিয়ায় উইঘুরদের বসবাস রয়েছে। এরা সুন্নি মুসলমান এবং অনেকেই সুফিবাদ চর্চা করেন।
চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের উইঘুর মুসলমানদের নিপীড়নের সংবাদ খুব আলোচনায় আসে। কিন্তু অন্যদিকে নাংশিয়া প্রদেশে বসবাসকারী কোটির বেশি হুই মুসলমানের নিরাপদ সুখী জীবনযাপনের খবর মিডিয়ায় তেমন আসে না। এই মুসলমানরা নাংশিয়া প্রদেশের কেন্দ্রীয় শহর তাংশিনে এবং এর কাছের শহরগুলোয় বসবাস করেন। এরা শুধু শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে উন্নতি করছে তা-ই নয়, বরং তারা সামাজিক এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার দিক থেকেও সুখী।
ইকোনমিস্ট পত্রিকার একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, গত কয়েক বছরে নাংশিয়ার হুই মুসলমানদের মসজিদের সংখ্যা ১৯০০ থেকে বেড়ে প্রায় ৪ হাজারে পৌঁছেছে। তাদের শিক্ষাগত অবস্থারও উন্নতি হচ্ছে। সেখানে নামাজ পড়া, রোজা রাখা এবং হজে যাওয়াতেও কোনো জটিলতা নেই। তারা স্বাধীনভাবে জনসভাও করতে পারে।
চীনের হুই মুসলমানরা রেশম পথ বরাবর বসবাসকারী ও চীনা স্ত্রী বিয়ে করা আরব ও পারস্যের বণিকদের বংশধর। তাদের সংখ্যা এখন ১ কোটি। জিনজিয়াংয়ের মুসলমানরা না পারলেও তারা শুরু থেকেই চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। জিনজিয়াংয়ের মুসলমানরা একটি তুর্কি উপভাষায় কথা বলে এবং তাদের চেহারায় ইউরেশীয় ছাপ প্রধান। পক্ষান্তরে হুইরা চীনা ভাষায় কথা বলে এবং প্রতিবেশীদের সঙ্গে তাদের দৈহিক সাদৃশ্য রয়েছে। হুই মুসলিমরা ইসলামের আধুনিক রূপের অনুসারী। তাদের ঐতিহ্য যদিও আন্তঃধর্ম বিবাহ অনুমোদন করে না; কিন্তু হুই পুরুষরা প্রায়ই ভিন্ন ধর্মের মেয়েকে বিয়ে করে এবং বলে যে তারা ইসলামে দীক্ষিত হয়েছে। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি আনুগত্যের জন্য তারা ভালোভাবে পুরস্কৃত হয়েছে। লিনজিয়ার মতো স্থানগুলোতে মুসলমানরা সহজেই পাসপোর্ট পেতে পারে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অর্ধেকই হুই। এর বিপরীতে জিনজিয়াংয়ে প্রায় সব ঊর্ধ্বতন পদেই হান চীনারা। উইঘুর তরুণদের বিদেশ যেতে পাসপোর্ট মেলে না। সরকারি কর্মচারীরা মসজিদে নামাজ পড়তে গেলে বা রোজার সময় রোজা রাখলে তাদের চাকরিচ্যুত করা হয়। তবে নিংজিয়া ও গানসুতেও সরকারি সহিষ্ণুতার সীমা আছে। কিন্তু সুদূর পশ্চিমাঞ্চলীয় জিনজিয়াং প্রদেশের উইঘুর মুসলমানদের ভাগ্য এতখানি প্রসন্ন দেখা যায় না। সেখানে জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে উইঘুর মুসলিমরা সরকারি চাপ ও পীড়নের শিকার হয়ে চলেছেন। অঞ্চলের অন্য জনগণ ও উইঘুরদের মধ্যে বরাবর একধরনের সমন্বয়হীনতা কাজ করে এসেছেÑ মূলত উভয় পক্ষের মধ্যকার ভাষাগত ভিন্নতার কারণে। উইঘুর জনগণ কথা বলে থাকেন তুর্কি ভাষায়। তাদের লেখায় ব্যবহৃত হয় আরবি বর্ণ। অন্যদিকে হুইরা কথা বলেন মান্দারিন ভাষায়।
সাক্ষাৎকারে বহু হুই মুসলিম বলেন, স্বাস্থ্যবিধিসম্মত ধর্মীয় নিয়মরীতি ও ব্যক্তিগত মর্যাদা বোধ এবং ধূমপান, মদ ও জুয়া পরিহার তাদের চীনা ভাইদের থেকে পৃথক করেছে। উঝংয়ে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও অন্যান্য মুসলিম দেশে পাগড়ি রপ্তানিকারী টুপি কারখানার উৎপাদন ব্যবস্থাপক ৩৫ বছর বয়স্ক মা ইউমিং বলেন, হুইরা আলাদা এলাকায় থাকে; কিন্তু আজকের দিনে অমুসলিমরাও মুসলিমদের এলাকায় আসছে আর তা আমাদের পরিষ্কার খাবার ও নৈতিকতা ব্যবস্থার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে। চীনা কম্যুনিস্ট পার্টি এ সুযোগকে কাজে লাগাতে হুই মুসলিমদের বাণিজ্যিক দূত হিসেবে বিভিন্ন মুসলিম দেশে প্রেরণ করছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন