বুধবার, ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯

খরমপুরের কেল্লা বাবা হযরত গেছু দারাজ (র:) এর অজানা কাহিনী।

"কূপটিকে পাহারা দেবার জন্য আছে ৪০ জন উলঙ্গ নারী। এরকম স্থানে কোনো আউলিয়া যেতে পারেন না।"
মোটামুটি সমস্ত অঞ্চলেই খরমপুরের কেল্লা বাবার ভক্ত বিদ্যমান। অনেক আগে থেকেই দেশের নানা প্রান্তের লোকেরা তার সম্বন্ধে জানতো। একটা সময় পর্যন্ত জানাশোনার সংখ্যাটা এত বেশি ছিল না। কেল্লা বাবার মাজার ও কেল্লা বাবা সম্পর্কে প্রচলিত উপকথা জনপ্রিয় হয়ে উঠে একবিংশ শতকের শুরুর দিকে। ২০০২-০৩ সালের দিকে শরীফ উদ্দিন নামে একজন তরুণ ভাণ্ডারী শিল্পীর আগমন ঘটে। কণ্ঠের মিষ্টতা কম আর বেশি যা-ই থাকুক সে কণ্ঠে ব্যতিক্রমতা ছিল সন্দেহ নেই। তিনি সে সময় কেল্লা বাবার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এবং তার গুণগান করে একটি একক অ্যালবাম প্রকাশ করেন। ব্যতিক্রমতার কারণে সে অ্যালবাম দ্রুত সময়ে জনপ্রিয় হয়ে যায়। এদিকে মানুষ জানতে শুরু করলো শিল্পী শরীফ উদ্দিন একজন গরীব ও নিম্নশ্রেণীর কর্মচারী। একটি ক্যাসেট ও সাউন্ড রেকর্ডিং-এর দোকানে কাজ করে। দোকানের মালিক তার ব্যতিক্রমী কণ্ঠ শুনে তার মাঝে সম্ভাবনা দেখতে পায় এবং কেল্লা বাবার গানে ঢুকিয়ে দেয়। এ ধরনের গল্পগুলোতে মানুষের খুব আগ্রহ থাকে।
শরীফ উদ্দিন বিখ্যাত হবার সাথে সাথে তার অ্যালবামের পরিমাণও বাড়তে থাকে। সব অ্যালবামই কেল্লা বাবার প্রতি স্তুতি গেয়ে প্রকাশিত। শরীফ এবং শরীফের অ্যালবামের সাথে সাথে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছেলে-বুড়ো-নারী-পুরুষ সকলের কাছে বিখ্যাত হয়ে যায় কেল্লা বাবার কাহিনী। তবে তার আগেও ভক্তদের মাঝে কেল্লা বাবা এবং তার মাজার সম্পর্কে বিভিন্ন কাহিনী প্রচলিত ছিল।
কেল্লা বাবার মূল নাম হযরত গেছু দারাজ (র:)। তার জন্মভূমি ইয়েমেনে। হযরত শাহজালাল (র:) যখন ধর্ম প্রচারের জন্য ইয়েমেন থেকে ভারতবর্ষে গমন করেন তখন তার সাথে হযরত গেছু দারাজ (র:) তথা কেল্লা বাবাও ছিলেন। হযরত শাহজালাল (র:)-এর সাথে তিনিও সিলেট এসেছিলেন এবং ইসলাম ধর্ম প্রচার করেছিলেন।
মানুষের মুখে মুখে তার অলৌকিকতা সম্পর্কে নানা ধরনের কাহিনী শোনা যায়। এ মুখ থেকে ঐ ঘুরে ঘুরে সেসব কাহিনী একপ্রকার উপকথায় পরিণত হয়ে গেছে। সেসবের মাঝে সবচেয়ে আগ্রহের কাহিনী হলো কীভাবে তার দেহ থেকে মাথা আলাদা হলো আর কেন সকলে তাকে মূল নামে না ডেকে কেল্লা বাবা বলে ডাকে। দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন হবার কাহিনীটির মাঝে রংচং তো লেগেছেই, উপরন্তু কিছু ক্ষেত্রে পুরো কাহিনীটিই বদলে গেছে। ভিন্ন ভিন্ন ঘটনায় মস্তক বিচ্ছিন্ন হবার ভিন্ন ভিন্ন বিবরণ পাওয়া যায়।
কথিত আছে, তৎকালে সিলেটের রাজা ছিলেন গৌর গোবিন্দ এবং তিনি ছিলেন অত্যাচারী। তার অত্যাচারের হাত থেকে নিরীহ জনগণকে বাঁচাতে যুদ্ধে লিপ্ত হন হযরত শাহজালাল (র:)। ঐ যুদ্ধে হযরত গেছু দারাজ (র:)-ও অংশগ্রহণ করেন। রাজা গৌর গোবিন্দের ছিল সাত তলা বিশিষ্ট দুর্ভেদ্য এক প্রাসাদ। গৌর গোবিন্দ সহ রাজ্যের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা অবস্থান করছিল প্রাসাদের ভেতরে। ভেতরে যাবার ফটক আবার অবরুদ্ধ। এমতাবস্থায় প্রাসাদকে জয় করার জন্য তীর-ধনুক দিয়ে কিছুক্ষণ চেষ্টা করা হলো। কিন্তু দূর থেকে কোনোভাবেই প্রাসাদ ভেদ করা যাচ্ছিল না।
এমন পরিস্থিতিতে ভিন্ন পথে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন হযরত শাহজালাল (র:)। তখন আসরের সময় হয়ে এসেছে। তিনি বললেন, “আমাদের মাঝে এমন কেউ কি আছে যে সারা জীবনে একবারও আসরের নামাজ জামাত ছাড়া আদায় করেনি?” এমন কঠিন শর্তে বলতে গেলে কেউই উত্তীর্ণ হবে না। কিন্তু খুঁজে একজনকে পাওয়া গেল যে তার জীবনের সকল আসর নামাজ জামাতের সাথে আদায় করেছে। তিনি হলেন হযরত গেছু দারাজ (র:)। তাকে বলা হলো সাত তলা প্রাসাদের কাছে গিয়ে আযান দিতে। তিনিও আযান দিতে গেলেন। যখন তিনি আযানের প্রথম অংশ ‘আল্লাহু আকবার’ বললেন তখন সপ্ততলা প্রাসাদের একটি তলা মাটির তলায় গুড়িয়ে গেল। এরপর যখন ‘আশহাদুআল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বললেন তখন আরেকটি তলা গুড়িয়ে গেল। এভাবে আযানের সাতটি অংশ বলার সাথে সাথে দুর্ভেদ্য প্রাসাদের সাতটি তলা মাটির নীচে ধ্বসে যায়।
প্রাসাদ ধ্বংস হবার সাথে সাথে হুড়োহুড়ি দিয়ে বের হতে থাকে শত্রুপক্ষের সৈন্য। এক সৈন্য এসে পেছন দিক থেকে তলোয়ার দিয়ে মস্তক বিচ্ছিন্ন করে ফেলে হযরত গেছু দারাজ (র:)-এর। পাশেই ছিল নদী। কর্তিত এই মাথা গিয়ে পড়ে নদীতে। অন্যদিকে মাথাবিহীন অবস্থাতেই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে দেহটি! জয় হবার আগ পর্যন্ত চলে এই যুদ্ধ।
এরপর সময় অতিবাহিত হয় এবং পানির স্রোতে এটি ধীরে ধীরে সিলেট থেকে সরে যেতে থাকে। একসময় এটি ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে চলে আসে। ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে অবস্থিত তিতাস নদী। একদিন কয়েকজন হিন্দু ব্যক্তি তিতাসে মাছ ধরছিলেন। জাল ফেলতে ফেলতে একপর্যায়ে কিছু একটার মাঝে জাল আটকে যায়। কষ্ট করে ডাঙায় তোলার পর দেখা যায় সেখানে একটি কর্তিত মাথা। তারা এটিকে ধরতে যাবে এমন সময় মাথাটি অলৌকিকভাবে কথা বলে ওঠে! মাথা অর্থাৎ কেল্লাটি জানায়, হিন্দু হয়ে এটিকে যেন তারা স্পর্শ না করে। স্পর্শ করার আগে তারা যেন অবশ্যই মুসলমান হয়ে নেয়। এমন অলৌকিকতায় তারা মুগ্ধ হয়ে যায় এবং সেখানেই মুসলমান হয়ে যায়। মুসলমান হতে হলে কলমা পড়তে হয়। তাদেরকে এই কলমাটিও পড়িয়ে দেয় ঐ কাটা কেল্লা।
এরপর কেল্লাটিকে তুলে এনে যত্নের সাথে কবর দেয়া হয় এবং কবরকে কেন্দ্র করে মাজার গড়ে তোলা হয়। কেল্লাটি পেয়েছিলেন চৈতন দাস ও তার কিছু সঙ্গী। ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর চৈতন দাসের নাম পালটে রাখা হয় শাহ্ সেওন। তিনিই ছিলেন কেল্লা বাবার মাজারের প্রথম খাদেম। বর্তমানে তার বংশধরেরাই মাজার শরীফের খাদেমের কাজে নিয়োজিত আছেন।
কাহিনির অন্য একটি ভার্সন হলো: এক হিন্দু জেলের জালে আটকা পড়ে এই কেল্লা এবং কথা বলতে থাকে অলৌকিকভাবে। তবে এই ভার্সনে একটু বাড়িয়ে বলা হয়, জালে যখন কেল্লা পড়ে তখন সেখানে ভূমিকম্প শুরু হয়। কেল্লাটিকে উপরে আনা হলে দেখা যায় সেটি আল্লাহর নামে জিকির করছে। একসময় সকলকে চলে যেতে বলে কেল্লাটি। সকলে চলে গেলে গায়েবীভাবে তিতাস নদীর পাড়ে একটি মাজার তৈরি হয়ে যায়। এটিই বর্তমানে কেল্লা শাহ্-এর মাজার নামে পরিচিত।
কাহিনীর আরেকটি ভার্সনে দেখা যায় সিলেটের যুদ্ধের সময় মৃত্যু হয়নি হযরত গেছু দারাজ (র:)-এর। সিলেট যুদ্ধে বিজয় লাভের পর তিনি হবিগঞ্জ (তৎকালীন শ্রীহট্ট) অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করতে লাগলেন। সেখানে ছিল আচক নারায়ণ নামে আরেকজন অত্যাচারী রাজা। এই রাজাকে অপসারণ ও শায়েস্তা করার জন্য দায়িত্ব দেয়া হয় হযরত গেছু দারাজ (র:)-কে। তিনি প্রকাশ্যে যুদ্ধ ঘোষণা করেন রাজার বিরুদ্ধে। রাজাকে চিঠি পাঠান যেন তার প্রজাদের প্রতি কোনো অত্যাচার করা না হয় এবং তাদের ধর্মেকর্মে যেন কোনোপ্রকার বাধা দেয়া না হয়। একপর্যায়ে তাদের মাঝে যুদ্ধ বেধে যায়। মুসলিমদের পক্ষে বেশ কয়েকটি অঞ্চল থেকে কয়েকটি দল মিলে যুদ্ধ করার কথা। হযরত গেছু দারাজ (র:) এর যাত্রাপথ ছিল সহজ ও সমতল, অন্যদিকে বাকিদের যাত্রাপথ ছিল বন্ধুর ও পাহাড়-টিলায় পূর্ণ। ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে অন্যদের এসে পৌঁছাতে দেরি হয়। আগে আগে চলে আসাতে বিপক্ষ দলের সাথে আগে আগে তুমুল যুদ্ধ বেধে যায় হযরত গেছু দারাজ (র:)-এর। সংখ্যায় শক্তিশালী না হওয়াতে কোণঠাসা হয়ে পড়ে গেছু দারাজ (র:)-এর দল, মারা যেতে থাকে মুসলিম সৈন্য। তবে দেরীতে হলেও বাকি দলগুলো আসে এবং একত্রে যুদ্ধ মোকাবেলা করে। এতে রাজা আচক নারায়ণ পরাজিত ও নিহত হয়।
যুদ্ধ জয়ের পর হযরত গেছু দারাজ (র:)-এর কোনো দেখা নেই। খুঁজে দেখা গেল তিনি মারা গেছেন কোনো এক অজানা ঘাতকের হাতে। মারার পর দেহ থেকে তার মাথা বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে। এই মাথাটিকে তারা ফেলে দেয় সেখানকার খোয়াই নদীতে। এরপর পানির প্রবাহে সেটি বরাক নদী হয়ে তিতাস নদীতে চলে আসে এবং খরমপুরে এসে দেখা দেয়।
কেল্লা বিচ্ছিন্ন হবার ঘটনাটি কোনো ক্ষেত্রে আবার একটু ভিন্নরকম। কাহিনীর এই ভার্সনেও যুদ্ধ হয় গৌর গোবিন্দের সাথে। এখানে বলা হয়, গৌর গোবিন্দের একটি রহস্যময় কূপ ছিল। এর নাম ছিল জীয়ন কূপ। এই কূপে কোনো মৃত লাশকে ফেলে দিলে তা জীবিত হয়ে যেতো। হযরত শাহজালাল (র:)-এর সাথে যখন যুদ্ধ বাধে তখন মুসলিম বাহিনীর হাতে প্রচুর সৈন্য মারা যেতে থাকে। কিন্তু সেসব মৃত সৈন্য নিয়ে ফেলে দেয়া হতো সেই কূপের মাঝে। ফলে তারা আবারো জীবিত হয়ে যুদ্ধ শুরু করতো। এমন পরিস্থিতিতে মুসলমানদের পক্ষে তাদেরকে হারানো অসাধ্য হয়ে যাচ্ছিল।
একপর্যায়ে হযরত শাহজালাল (র:) উপলব্ধি করতে পারলেন যতক্ষণ না ঐ কূপটি ধ্বংস করা হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত যুদ্ধে জয়লাভ সম্ভব নয়। যুদ্ধে তার সাথে ছিল তিন শত ষাট জন আউলিয়া। সবাইকে ডেকে বলা হলো কে পারবে সাহসের সাথে এই কূপটিকে ধ্বংস করে দিতে? ৩৬০ জনের কেউ রাজি হলো না। কারণ ইসলামি নিয়ম অনুসারে এটি সামনাসামনি যুদ্ধের চেয়েও কঠিন। এই কূপটিকে পাহারা দেবার জন্য আছে ৪০ জন উলঙ্গ নারী। এরকম স্থানে কোনো আউলিয়া যেতে পারেন না।
অবস্থা দেখে হযরত শাহজালাল (র:) খুব চিন্তিত হয়ে গেলেন। হযরত গেছু দারাজ (র:) ছিলেন হযরত শাহজালাল (র:)-এর ভাগ্নে। তিনি তার চিন্তিত মুখ দেখে আর সইতে পারলেন না। রাজি হলেন এই কঠিন কাজ তিনি করবেন। তার কাছে ছিল একটি ধারালো তরবারি। যখন তিনি কূপের নিকট গেলেন তখন ইসলামের সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য সেই তরবারি দিয়ে এক কোপে নিজের মস্তক নিজেই কেটে ফেলে দেন। মস্তকবিহীন রক্তাক্ত দেহ নিয়ে তিনি যখন সেই কূপের কাছে গেলেন তখন এই অবস্থা দেখে উলঙ্গ নারীদের সকলে উদ্ভ্রান্তের মতো ভয়ে পালিয়ে যায়। এরপর তিনি ঐ কূপে এক টুকরো গরুর মাংস ফেলেন। এটি ফেলাতে কূপের যাদুটি নষ্ট হয়ে যায়। মৃতকে পুনরায় জীবিত করার ক্ষমতা আর থাকে না এতে। গরুর মাংস ফেললে কেন জীবিত করার ক্ষমতা নষ্ট হবে সে সম্বন্ধে কোনোকিছু জানা যায়নি।
মস্তক ছাড়া দেহটি এরপর হযরত শাহজালাল (র:)-এর পায়ের সামনে গিয়ে প্রাণ ত্যাগ করে। এমন ত্যাগ দেখে সেদিন তিনি বলেছিলেন “কেউ যদি আমার দরগাহ জিয়ারত করতে আসে, তাহলে সে যেন সবার আগে কেল্লা শাহ-এর মাজার জিয়ারত করে নেয়। তা না হলে ঐ ব্যক্তির জিয়ারতের অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে।
(From Net)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন